| ২৬ আগস্ট ২০১৮ | ১০:০৫ অপরাহ্ণ
“মওতুল আলিমি মওতুল আলম” তথা একজন আলেমের মৃত্যু সারা জাহানের মৃত্যুর সমতূল্য। সে হিসেবে গত ২৩ এপ্রিল’১৮ ইং সোমবার দিনটি ছিল মুসলিম উম্মাহর জন্য বেদনাদায়ক দিন। সেদিন সকাল ৯ টা ৪০ মিনিটে এ ক্ষণস্থায়ী পৃথিবী ছেড়ে মাওলাপাকের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন শাইখুল আরবে ওয়াল আজম কুতবুল আলম শাহ সোলতান আহমদ নানুপুরী রহ. এর শ্রেষ্ঠতম খলীফা, জামিয়া ইসলামিয়া সোলতানিয়া লালপোল ফেনী’র প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম ও শাইখুল হাদিস, পীরে কামেল, হাকীমুল ওলামা আল্লামা মুফতী ছাঈদ আহমদ রহ.।
তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র, গাংগুহী সিলসিলার সমকালীন শ্রেষ্ঠ ধারক ও বাহক, আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা মুফতী, বিশিষ্ট হাদীস বিশারদ, যুগ সচেতন সাহসী নির্ভীক দ্বীনের কান্ডারী, সুন্নতে রাসূল সা. এর মূর্তপ্রতীক, অনন্য তাকওয়া-পরহেজগারী ও বহুগুণের অধিকারী বিশিষ্ট বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব। তিনি মানুষকে শরীয়তের সঠিক দিক নির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি হাজার হাজার পথহারা মানুষকে সঠিক পথের দিশা দিয়ে যান। আল্লাহভোলা বান্দাদেরকে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক করার মেহনতে রত ছিলেন আজীবন। তাঁর মৃত্যুতে দ্বীনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম জান্নাতুল ফেরদাউসের অধিকারী বানান। তাঁর অবর্তমানে দ্বীনী অঙ্গনে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণের জন্য তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী তৈরী করে দিন। আমীন।
এ মহান ব্যক্তির অনুপম জীবন চরিত ছিল অনুকরণীয়। তাঁর বিস্তারিত জীবনী পত্রস্থ করার জন্য হাজার পৃষ্ঠাও যথেষ্ট নয়। বক্ষমান নিবন্ধে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী পেশ করা হল।
★জন্ম ও পরিচয়ঃ
আল্লামা মুফতী ছাঈদ আহমদ রহ. ১৯ চৈত্র- ১৩৫৪ বাংলা, রোজ শুক্রবার জুমার নামাযের পূর্বে ফেনী জেলার অন্তর্গত ছনুয়া গ্রামের এক দ্বীনদার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাজী এহসানুল্লাহ সওদাগর ও মাতার নাম আসিয়া।
জনৈক বুযুর্গের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হল
মুফতী সাহেব রহ. এর মাতা-পিতা উভয়েই ছিলেন আলেম-ওলামার প্রতি যথেষ্ট দুর্বল ও আল্লরিক। এজন্য সর্বদা কোনো আলেমকে তাঁদের ঘরে জায়গীর রাখতেন। অথচ তাঁদের ঘরে লেখাপড়া করার মত কোনো সন্তান ছিল না। সে হিসেবে মাওলানা কবীর আহমদ নামক একজন বুযুর্গ তাঁদের ঘরে জায়গীর থাকতেন। মুফতী সাহেব রহ. এর আবক্ষাজান উক্ত মাওলানা সাহেবসহ জুমার নামায আদায় করতে গেলেন। নামায শেষে বাড়িতে এসে নবাগত শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলেন। তখন পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেছে জেনে উক্ত মাওলানা সাহেব বলেন, এ ছেলে হয়ত ভবিষ্যতে বড় আলেম হবে। পরবর্তীতে সে ভবিষ্যদ্বাণীটি ষোল আনাই বাস্তবরূপ লাভ করে।
★শিক্ষা জীবনঃ
মুফতী সাহেব রহ. এর ছোট বেলা থেকেই ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি অত্যন্ত আগ্রহ ছিল। তাঁর মাতা-পিতা তাঁকে জনৈক হিন্দু শিক্ষকের নিকট সোপর্দ করার শত চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। একটি স্কুলে তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল, স্বভাবগতভাবে স্কুলে তাঁর তন্ (শরীর) গেলেও মন যেতো না। এভাবে দু’বছর স্কুলে পড়ার পর তাঁকে স্থানীয় রহিমপুর মাদরাসায় ভর্তি করা হয়। মাদরাসার পড়া তাঁর স্বভাবের সাথে খাপ খাওয়ার কারণে মাদরাসায় ভর্তি করানোর সাথে সাথে পড়া লেখার প্রতি তাঁর আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। উক্ত মাদরাসায় তিনি জামাতে হাশতুম পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন।
*জামালপুর মাদরাসায় অধ্যয়ন
রহীমপুর মাদরাসায় জামাতে হাশতুম পর্যন্ত পড়ার পর তাঁর বিশিষ্ট উস্তাদ মাওলানা আব্দুল মতিন সাহেব তাঁকে মিরশ্বরাই জামালপুর মাদরাসায় ভর্তি করান। জামালপুর মাদরাসায় তিনি জমাতে দুওম পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। উল্লেখ্য যে, জামালপুর মাদরাসায় জামাতে সউম পর্যন্ত ছিল। তাঁর খাতিরে জামাতে দুওম খোলা হয়েছিল। প্রতি পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করতেন। এমনকি তিনি জমাতে সউমের (দ্বাদশ শ্রেণি) বছর এত্তেহাদুল মাদারিসিল কওমিয়া (বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড) এর কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় সারা দেশের মধ্যে প্রথম হন।
তিনি জামাতে হাফতুমের বছর থেকেই নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামায পড়তে অভ্যস্ত হন। জমাতে চাহারুমের বছর স্বপ্নে দেখলেন যে, কুতবুল আলম পটিয়ার হযরত মুফতী আজিজুল হক সাহেব রহ. তাঁকে শাইখুল মাশায়েখ হযরত শাহ সোলতান আহমদ নানুপুরী রহ. এর হাতে তুলে দেন। এজন্য তিনি চাহারুমের বছর নানুপুরী হযরত রহ. এর হাতে বাইআত হন।
জামালপুর মাদরাসা থেকে বিদায় নিয়ে পটিয়া মাদরাসায় যাওয়ার সময় এই প্রিয় ছাত্রটিকে মাদরাসার মুহতামিম সাহেবসহ মাদরাসার সকল ছাত্র-শিক্ষক জামালপুর মাদরাসা থেকে দেড় মাইল দূরে ‘চিনকি আস্তানা’ নামক রেল স্টেশনে এগিয়ে দিতে আসেন। স্টেশনে কান্নাকাটির রোল পড়ে যায়। যার কারণে রেলগাড়ি ছাড়তেও বিলম্ব হয়।
*পটিয়া মাদরাসায় অধ্যয়ন
তাঁর একান্ত উস্তাদ মাওলানা আব্দুল মতীন সাহেব তাঁকে সাথে নিয়ে পটিয়া মাদরাসায় ভর্তি করালেন। বোর্ডের পরীক্ষায় ১ম স্থান অধিকার করায় মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তাঁর ভর্তি পরীক্ষা নেননি। পটিয়া মাদরাসায় যে সকল বিভাগ রয়েছে অর্থাৎ মুনাযারা বিভাগ, মুশাআরা বা কবিতা রচনা বিভাগ, আরবি সাহিত্য বিভাগ ও উর্দূ সাহিত্য বিভাগসহ প্রত্যেক বিভাগের পরিচালকগণ তাঁর নাম নিজেদের বিভাগে লিপিবদ্ধ করে ফেলেন। উপর্যুক্ত প্রত্যেক বিভাগেই তিনি যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। মুনাযারা বিভাগের যিম্মাদার তাঁর মুনাযারা করার যোগ্যতা দেখে তাঁকে ‘সাইয়্যেদুল মুনাযিরীন’ উপাধি দেন। বার্ষিক মুনাযারা ও কবিতা রচনা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করে পুরস্কৃত হন।
পটিয়া মাদরাসায় তিনি দু’বছর অধ্যয়ন করেন। প্রথম বছর ফুনুনাতে আলিয়া পড়েন। ফুনুনাতের কিতাব ‘কাজী হামদুল্লাহ’ পড়েছেন খতীবে আযম আল্লামা সিদ্দীক আহমদ রহ. এর নিকট। তিনি কয়েকদিন পড়ানোর পর মুফতী সাহেবের যোগ্যতা অনুমান করতে পেরে বলেন, আমাকে আর পড়াতে হবে না। আগামীকাল থেকে তুমি কিতাব দেখে এসে অর্থসহ বলবে আর আমরা শুনব। মোল্লা জালাল নামক কিতাব পড়েছিলেন ফকীহুল মিল্লাত মুফতি আবদুর রহমান রহ. এর নিকট। উক্ত কিতাব খারেজী ঘন্টায় তিনি একাই পড়েছিলেন। ফুনুনাতের বছরও প্রত্যেক পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন।
চলবে…..