| ২০ এপ্রিল ২০১৯ | ৫:৫৯ অপরাহ্ণ
বরকতময় মাস রমজান একজন মোমিনের কাক্সিক্ষত সময়। জীবন পরিবর্তনের এক বাস্তব বিরল সুযোগ হিসেবেই এ মাস আগমন করে। সুতরাং রমজানকে গতানুগতিক ধারায় কাটিয়ে দেওয়া সুস্থ বিবেকের কাজ নয়। কাজেই আল্লাহর আনুগত্যে রমজানের রাত-দিনকে কাটানোর জন্য কার্যকরী একটি পরিকল্পনা তৈরি করা উচিত। এ পরিকল্পনায় কয়েকটি জিনিস থাকতে পারে।
১. রমজানে বেশি সময় ইবাদতে কাটানোর জন্য কিছু কাজকর্ম, অনুষ্ঠান, ভ্রমণ ও প্রোগ্রাম রমজান-পূর্ব সময়ে সেরে নেওয়া। রমজানে শপিংয়ের ঝামেলা এড়াতে এখনই কেনাকাটা খতম করে ফেলা উচিত। ২. বিশেষ কোনো রোগব্যাধি থাকলে রমজানের আগেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রমজানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করা। ৩. হাটবাজারে সময় নষ্ট না করার জন্য যথাসম্ভব হাটবাজার রমজানের আগেই সেরে নেওয়ার চেষ্টা করা। ৪. রমজানে পালনীয় ইবাদত-বন্দেগিসংক্রান্ত বিধিবিধান রমজানের আগেই জেনে নেওয়া। যেন এগুলো আল্লাহর দরবারে সহিহ ও গ্রহণযোগ্য হয়। আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা না জান তাহলে জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করো।’ (সূরা আম্বিয়া : ৭)।
এ লক্ষ্যে রমজানের গুরুত্ব, ফজিলত এবং করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কিত কিছু গ্রহণযোগ্য ও প্রামাণ্য বই পড়ে নেওয়া যেতে পারে। এছাড়াও নিজস্ব অবস্থান হিসাব করে রমজান উদযাপনের জন্য ব্যক্তিগত প্র্রস্তুতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত।
কোরআন তেলাওয়াত : রমজানের প্র্রস্তুতি হিসেবে এখন থেকেই রোজার পাশাপাশি বেশি পরিমাণে কোরআন তেলাওয়াত করা উচিত। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন শাবান মাস আসত, তখন মুসলিমরা খুব বেশি কোরআন তেলাওয়াত করতেন। (লাতাইফুল মাআরিফ : ইবনে রজব হাম্বলি)। পূর্ববর্তী কোনো কোনো আলেম বলেছেন, শাবান হলো কোরআন তেলাওয়াতকারীদের মাস। আমাদের অনেকেই হয়তো গত রমজানে কোরআন শরিফ তাকে তুলেছি। হয়তো ধুলাবালু-ময়লা পড়ে গেছে কোরআনের গায়ে। কোরআনটাকে নামিয়ে পরিষ্কার করি। বুকে জড়িয়ে ধরি। আর আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে বলি, কোরআনের যে হক আমি নষ্ট করেছি, সেজন্য ক্ষমা চাই। আর কখনোই আমি কোরআন ছাড়ব না। কোরআন তেলাওয়াত করি। পারলে অর্থসহ পড়ার চেষ্টা করি। কোরআন পড়তে না জানলে রমজানের আগেই শিখে নিই। বিভিন্ন পদ্ধতিতে এখন অল্প সময়েই কোরআন তেলাওয়াত শেখা যায়। আশপাশের মসজিদ-মাদ্রাসাগুলোতে খোঁজ নিলেই আপনার এলাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ঠিকানা পেয়ে যাবেন।
পারিবারিক প্র্রস্তুতি : রমজান আসার আগেই তার পরিপূর্ণ বরকত ও পুণ্য অর্জনে পরিবারকে মনোযোগী এবং আগ্রহী করতে পারিবারিক তালিম করা যেতে পারে। পরিবারের কোনো সদস্য কোরআন তেলাওয়াত করতে না পারলে তাকে শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। পরিবারের সবাই যেন রমজানে বেশি পরিমাণ তেলাওয়াত করতে পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। রমজানের কাজকর্মের ভিড়ে পরিবারের নারী সদস্যরা যেন আমল করতে অপারগ না হয়, সেদিকে লক্ষ রেখে প্রত্যেক সদস্যকে বিভিন্ন কাজ ভাগ করে নিতে হবে। পারস্পরিক সহযোগিতা করতে হবে। রমজানকে পরিপূর্ণ গুরুত্ব দিতে অনৈসলামিক টিভি প্রোগ্রামমুক্ত এবং সব বেহুদা কাজমুক্ত পরিবার গঠন করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।’ (সূরা তাহরিম : ৬)।
সামাজিক প্র্রস্তুতি : রাসুল (সা.) রমজান-পূর্ব সময়ে সমাজের লোকদের রমজান আগমনের বার্তা দিতেন। পাড়া-প্রতিবেশীসহ সবাইকে রোজা রাখার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতেন। রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় এ মাস আসার আগেই সামাজিকভাবে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। সবারই খেয়াল রাখা উচিত, নিজের দ্বারা যেন কোনো রোজাদারের ক্ষতি না হয়। পবিত্রতা রক্ষার স্বার্থে রমজানে গানবাজনা, সিনেমা, হোটেল ইত্যাদি বন্ধ রাখতে হবে। পাশাপাশি অশ্লীল কথাবার্তা ও কাজকর্ম থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে হবে। দীর্ঘ এগারো মাসের পাপাচারের কারণে অন্তরে যে কালিমা লেপন হয়েছে, তা দূর করতে হবে এবং কুপ্রবৃত্তির লাগাম টেনে ধরতে হবে। রমজানের মর্যাদাগুলোর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করতে হবে। রমজানের প্র্রস্তুতিমূলক সভা-সমাবেশ ও সেমিনারসহ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় রমজানের আলোচনা বৃদ্ধি করতে হবে, যেন সামাজিকভাবে সবাই রমজানের জন্য প্র্রস্তুত ও আগ্রহী হয়। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি উপদেশ দিতে থাকো, কারণ উপদেশ মোমিনদের উপকারে আসবে।’ (সূরা জারিয়াত : ৫৫)।
অর্থনৈতিক প্র্রস্তুতি এবং দানসদকা ও জাকাতের হিসাব : রমজানের বাজার যেহেতু আমাদের দেশে একটু ভিন্ন রূপ ধারণ করে; তাই প্রয়োজনের অতিরিক্ত দ্রব্য কেনা থেকে বিরত থাকা উচিত। অর্থনৈতিকভাবে অন্যকে সহযোগিতা করতে হবে। দানের হাত প্রসারিত করতে হবে। রাসুল (সা.) রমজান মাসে প্রচুর পরিমাণ দান করতেন। (বোখারি : ৬; মুসলিম : ৬১৪৯)। আত্মীয়স্বজন এবং পাড়াপড়শিকে হাদিয়া দেওয়ার জন্য খেজুর-চিনি ক্রয় করা যেতে পারে।
তাছাড়া রমজানে দানসদকা করার জন্য এখন থেকেই সাধ্যমতো অর্থ জোগাড় করে রাখা উচিত। রমজান মাসে ইবাদতের সওয়াব বৃদ্ধি পায় বিধায় আমরা সাধারণত রমজানে জাকাত প্রদান করে থাকি। সে লক্ষ্যে জাকাতের হিসাবও এখনই করে রাখা উচিত, যেন রমজান শুরু হওয়া মাত্রই আমরা সদকার হাত প্রশস্ত করে দিতে পারি। হজরত আনাস (রা.) বলেন, ‘আমাদের বড়রা রমজানের আগেই দুর্বল ও দরিদ্রদের রমজানের রোজায় সহযোগিতা করার জন্য তাদের সম্পদ থেকে জাকাতের অর্থ বের করে নিতেন।’ (লাতাইফুল মাআরিফ : ইবনে রজব হাম্বলি)।
পণ্যের দাম বৃদ্ধি রোধ : রমজান মাসকে সামনে রেখে অনেক মুনাফালোভী ব্যবসায়ী পণ্যে ভেজাল মেশান ও মূল্যবৃদ্ধি করেন। এগুলো রোধ করতে হবে। রমজান মাসে সাধারণ ভোক্তাদের গলায় ছুরি ধরে অমানবিক লাভের চেষ্টা করা অত্যন্ত গর্হিত ও ঘৃণিত কাজ। পাপ সবসময়ই পাপ; কিন্তু পবিত্রতম সময়ে বা পবিত্রতম স্থানে পাপ করা মহাপাপ বা সীমার অতিরিক্ত লঙ্ঘন। কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বারবার বলেছেন, ‘তোমরা সীমালঙ্ঘন করো না।’
রমজান এলেই একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান। এ সুযোগে মুনাফা করে নেন কয়েক গুণ। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে বাড়তি ফায়দা লোটার চেষ্টা করেন। এ কারণে ভালো সব পণ্য থাকে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ঊর্ধ্বে। এটি শুধু চরম অন্যায়ই নয়; অমানবিকতাও বটে। এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের সচেতন হওয়া উচিত। দাম বাড়ানোর কারণে যেন কোনো রোজাদার কষ্টে না পড়েন এবং নিজেরাও যেন হালাল উপার্জন দিয়ে রোজা পালন করতে পারেন, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। শুধু পার্থিব লাভ নয়, জীবনে বরকত পাওয়ার জন্যও তো কিছু কাজ করা চাই।
ইতিকাফ করার সংকল্প : রমজান মাসের শেষ দশকে রয়েছে বিশেষ রজনী লাইলাতুল কদর। দুনিয়ার সব পেরেশানি থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ার জন্য রয়েছে ইতিকাফের সুবর্ণ সুযোগ। জীবনের অনেক বসন্তই হয়তো কেটে গেছে ইতিকাফের স্বাদ থেকে বঞ্ছিত থেকে। এ রমজানে যেন ইতিকাফ মিস না হয়, সেজন্য এখন থেকেই সংকল্প গ্রহণ করতে হবে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিশ্বাসের সঙ্গে, সওয়াব লাভের আশায় ইতিকাফ করে তার পেছনের সব গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।’ (দায়লামি : ৫৪৪২)। আরও এরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একদিন ইতিকাফ করবে আল্লাহ তায়ালা ওই ব্যক্তি ও জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক দূরত্ব সৃষ্টি করে দেবেন, যা দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে পূর্ব-পশ্চিম দিগন্ত থেকেও বেশি দূরত্ব সম্পন্ন হবে।’ (শুআবুল ঈমান : ৩৬৭৯)।
ওমরার জন্য প্রস্তুতি : রমজান মাসে ওমরা করার সওয়াব অনেক বেশি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রমজান মাসে ওমরা করলে হজের সওয়াব পাওয়া যায়।’ (বোখারি : ১৭৮২, মুসলিম : ১২৫৬)। মুসলিমের অন্য বর্ণনামতে, ‘রমজান মাসে ওমরা করলে নবীজির সঙ্গে হজ করার সওয়াব লাভ হয়।’ তাই সামর্থ্যবান ব্যক্তিমাত্রই এ সুযোগ গ্রহণের ফিকির করতে পারেন।
লেখক : পেশ ইমাম ও খতিব
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | |||||
৩ | ৪ | ৫ | ৬ | ৭ | ৮ | ৯ |
১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ |
১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০ | ২১ | ২২ | ২৩ |
২৪ | ২৫ | ২৬ | ২৭ | ২৮ | ২৯ | ৩০ |