লেখক: এইচ. এম নুরে আলম (জাহাঙ্গীর)। সম্পাদক : আওয়ার কণ্ঠ | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | ৫:১৮ পূর্বাহ্ণ
বছর ঘুরে যখন ফেব্রুয়ারি আসে তখন রক্তাক্ত দিনগুলি চোখের সামনে ভেসে উঠে। কারণ এই ফেব্রুয়ারি মাসেই এ দেশের ছাএ-জনতা, আলেম-উলামা ও সেনা অফিসারদের গণ-হত্যার এক কালো অধ্যায় রচিত হয়েছে। পর পর চারটি হৃদয় বিদারক ট্রাজেডি সংঘঠিত হয়েছে বাংলার এ পূত-পবিত্র ভূমিতে।
অত্যাচারীরর কালো হাতের হিংস্র থাবা ও বুলেট ঝাঁঝরা করে দেয় জাতির ভবিষ্যৎ ছাত্র -জনতা, উম্মার রাহ্বার উলামায়ে কেরাম ও দেশের সূর্যসন্তান সেনা অফিসারদের বক্ষদেশ। সেই ঘৃণ্য ও ন্যাক্কার জনক অপকর্মের নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই।
১.সেই ১৯৪৮ সালের কথা। পৃথিবীর মানচিত্রে তখন বাংলাদেশের সতন্ত্র কোন পরিচিতি ছিল না। পূর্ব পাকিস্তান নামে একটি অঙ্গরাজ্য হিসাবে তার পরিচিতি ছিল।
এ রাজ্যের রাষ্ট্রভাষা কি হবে এ প্রশ্নে শাসক গোষ্ঠী ও বাংলার আপামর জনতা দুই মেরুতে অবস্থান করে। তৎকালিন শাসকগোষ্ঠী খোদার অপার দান এই মায়ের ভাষা ও মাটির ভাষা, স্বপ্নের ভাষা ও চিন্তার ভাষা বাংলাকে ছিনিয়ে নিয়ে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল তাদের নিজেদের ভাষা উর্দুকে। হস্তক্ষেপ করতে চেয়েছিল মায়ের সুবাসিত শ্বাস আর মায়াবী ডাকের বিন্দু বিন্দু নির্যাসে সৃষ্ট হৃদয়ের গভীরে পোষা প্রিয় বাংলা ভাষার উপর ।
কিন্ত বাংলার সভ্য স্বাধীন নাগরিকেরা সেই নগ্ন হস্তক্ষেপ কে মেনে নেয়নি, গ্রহণ করেনি শাসকশ্রেণীর অন্যায় ভাবে চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তকে। তাই ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বাংলার রফিক, বরকত,সালাম ও জব্বার সহ অনেক সাহসী ভাষা প্রেমিক বুকের তপ্ত খুন ঢেলে দিয়েছিল বন্দি মাতৃভাষাকে মুক্ত করার জন্যে, জীবন উৎসর্গ করেছিল মায়ের দেশে মায়ের ভাষাকে স্বাধীন করার লক্ষে।
তাদের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ। তাদের এই আত্মদান ও জীবন বিসর্জনের ফলেই ১৯৫৬ সালের মার্চে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা দুইটির একটি হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
(২) সময় তখন ১৯৮৩ সাল। রাষ্ট্রক্ষমতা তখন স্বঘোষিত স্বৈরশাসকের হাতে। সে সময়ের শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খান এক বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি চালু করেন। এর প্রতিবাদে ছাত্র-জনতা এক ব্যপক আন্দোলন গড়ে তুলেন। দেশ ও দেশের গণতন্ত্রের প্রয়োজনে অনেক ছাত্র তাদের জীবনোৎসর্গ করেন। শহীদ ছাত্রদের রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছে এবং পরবর্তীতে স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটে ।
স্বৈরাচার সরকারের শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খানের বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, বন্দীদের মুক্তি ও জনগণের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ছাত্র সংগঠনগুলো ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি দেয়।
ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশ নির্বিচারে গুলি নিক্ষেপ করে।
এতে জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দিপালী সাহা, মোজাম্মেল ও আইয়ুবসহ প্রায় ১০ জন শিক্ষার্থী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন, আহত হন শতাধিক। যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, যাদের রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচার সরকার বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছিল, তাদের কি ভুলা যায়?
কিন্তু আমরা তাদের ভুলেই গেছি, মিছে ভালবাসা দিবসের নামে মেতে উঠছি নষ্টামিতে। ভুলে গেছি আমাদের তারুণ্যের ইতিহাসকে।
৩.১৯৪৭সালে ভারত থেকে পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার পেছনে প্রধান ইস্যু ছিল দুই দেশের মানুষ নিজ নিজ ধর্ম পালনে স্বাধীন থাকা। কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না হানা।
কিন্তু ১৯৯৬ সালে তৎকালীন সরকার এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমানদের গনতান্ত্রিক ধর্মীয় স্বাধীনতাকে খর্ব করে কুরআন, ইসলাম ও মুসলিম উম্মার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের নীল নকসা আঁকতে থাকে।
ইসলামী চেতনা ও মুল্যবোধকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চক্রান্তের জাল বুনতে থাকে। এরই ফলশ্রুতিতে ইসলামের মূল বিধান ‘ফতোয়া’র উপর নগ্ন হস্তক্ষেপ করে এ দেশ থেকে সব ধরনের ফতোয়া কে তুলে দেয়ার লক্ষে হাইকোর্ট থেকে সব ধরনের ফতোয়াকে অবৈধ করা হয়।
এই ঘোষনা মুসলমানদের অন্তরে বিরাট আঘাত হানে। ক্ষোভে ফোঁসে উঠে গোটা দেশ। উম্মাহর রাহবার উলামায়ে কেরাম আন্দোলনের ডাক দেন।
এই দেশের তৌহিদী জনতা যখন আলেম-উলামাদের ডাকে সাড়া দিয়ে তাদের নেতৃত্বে আন্দোলনের মাঠে নেমে পড়ে ঠিক তখনই বাকশালী সরকার এই আন্দোলনের তীব্রতাকে ভয় পেয়ে এদেশের আলেম-উলামাদের উপর আদা-জল খেয়ে নেমে পড়ে। শুরু হয় বাকশালী সরকারের গ্রেফতার অভিযান ।
৩রা ফেব্রুয়ারি ইসলামি ঐক্যজোটের মহা সচিব (পরবর্তীতে চেয়ারম্যান) আল্লামা মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ)সহ শতাধিক আলেমকে গ্রেফতার করে।
৪ঠা ফেব্রুয়ারির রাত্রে জাতি যখন রাহবার বন্দির ব্যাথায় কাতর, যখন দেশ জুরে নিস্তব্ধতার ছায়া বিরাজ করছে, দেশবাসী যখন ঘুমে বিভোর তখন রংপুরের জনসভা থেকে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান শাইখুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হক (রহ) ও মুফতি ইজহারুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। এতে পরিস্থিতি আরো গোলাটে হয়।
পরদিন ৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে সারা দেশ জুড়ে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। অসংখ্য আলেম -উলামার লীলাভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও তাওহিদী জনতা ধর্মীয় নেতাদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ করে। আল্লামা সিরাজুল ইসলামক (বড় হুজুর) (রহ) বিক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করার লক্ষে পরের দিন ৬ই ফেব্রুয়ারি তাছবিহ হাতে জিকিরের সাথে শান্তিপূর্ণ ভাবে স্ব স্ব স্থান থেকে হরতাল পালনের আহ্বান জানান । ৬ফেব্রুয়ারি ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে মসজিদের মিনারা হতে। মুসলিম জনতার ঘুম ভাঙলো স্বপ্ন ভাঙলো না। কিন্তু ৬ জনের পৃথিবীর স্বপ্ন ভেঙে গেল, তারা পরজগতের স্বপ্নে বিভোর হলো।
ফজরের নামাজ আদায় করে তাছবিহ হাতে কাফনের কাপড় মাথায় সকলেই বেরিয়ে পড়লো, শুরু হলো ফতোয়া রক্ষার হরতাল। শান্তিপূর্ন ভাবেই হরতাল চলছিল। সকাল শেষ হয়ে যখন দুপুর আসন্ন তখনই শুরু হলো পুলিশ ও সরকার দলীয় ক্যাডারদের পরিকল্পিত অতর্কিত হামলা। পুলিশ বন্দুক চালালো, গুলি করলো আর একে একে লুটিয়ে পড়লো হাফেজ তাজুল ইসলাম, হাফেজ সাইফুল ইসলাম সহ ঈমান দীপ্ত ছয়টি তাজা প্রাণ।
রক্তের শ্রোতধারায় প্লাবিত হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পবিত্র ভূমি। ৬ শহিদের একজন হলো শহীদ সাইফুল ইসলাম, তাকে মর্গে নেয়া ব্যতীতই জানাযা পড়ে সমাধিস্ত করা হয়। পুলিশ তার শাহাদাতের বিষয়টি অস্বীকার করলে ১৮দিন পর তার লাশ তুলা হয়। শহীদ সাইফুলোর লাশ দেখেতো সবাই অবাক! আঠার দিন অতিবাহিত হবার পরেও তার দেহে কোন পরিবর্তন হয়নি, তার চেহারা নূরে ঝলমল করছে তার সমাদি থেকে অদ্ভুতপূর্ব এক জান্নাতি খুশবো ছড়াচ্ছে।
আলেম উলামাদের নির্যাতনের প্রতিবাদ ও ৬শহীদের বদলা নিতে দেশের মানুষ ফুঁসে উঠেছিল ৷
ঠিক তখনই ৪ দলীয় জোট সরকারের প্রধান ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে অঙ্গিকার করেছিল তাদেরকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করলে ক্ষমতায় গিয়ে তারা ৬ শহীদের বিচার করবে ৷
কিন্তু শহীদদের রক্তে পা দিয়ে,আলেমদেরকে ক্ষমতার সিঁড়ি বানিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে একটি দিনের জন্যও শহীদদের স্মরন করেন নি ৷ তাদের দেওয়া সকল প্রতিশ্রুতির একটিরও বাস্তবায়ন করেনি।
পরবর্তীতে তাদের জীবনের বিনিময়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল করে ফতুয়াকে বৈধ ঘোষণা করা হয়।
৪.২০০৯সালের ২৫ ও ২৬ শে ফেব্রুয়ারি। এ দু’দিনে বাংলাদেশের ইতিহাসে অবতারণা ঘটে এক কলংকময় অধ্যায়ের। দেশ ও মাতৃকা রক্ষায় নিবেদিত শতাধিক সেনা অফিসারকে পিলখানায় নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। ইতিপূর্বে কোন দেশ যুদ্ধ ব্যতীত শতাধিক অফিসার হারিয়েছে এমন নজীর পৃথিবীর বুকে দ্বিতীয়টি নেই। দেশকে নেতৃত্ব শূন্য ও পরনির্ভর করার হীন চক্রান্তে, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে বিকিয়ে দেয়ার কুটিল ষড়যন্ত্রে মেতে উঠা এক সার্থান্বেষী মহলের ইন্দনেই যে এ ঘটনা ঘটেছে তাতে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই। যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তাদের অপূরণীয় অভাব আজো পূরণ হয়নি,
আগামী দশকেও হবে কিনা জানিনা।
যে বা যারা এ ঘৃণ্য অপকর্মের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নেতৃত্ব দিয়েছে বা সহযোগিতা করেছে তাদের খুঁজে বের করে এ বাংলার জমিনে প্রকাশ্যে এমন দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দেয়া উচিৎ যাতে দেশ ও জাতির দুশমনেরা ভবিষ্যতে এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি করার দুঃ সাহস না দেখাতে পারে।
পরিশেষে পিলখানা হত্যাকান্ডে নিহত শহীদ সাহসী সৈনিকদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
লেখক: এইচ. এম নুরে আলম (জাহাঙ্গীর)
সম্পাদক : আওয়ার কণ্ঠ ২৪. কম
কাতার প্রতিনিধি : এস.টিভি