| ০৩ এপ্রিল ২০২১ | ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীকে সামনে রেখে ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘরের সজ্জিতকরণের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘর নিয়ে লিখেছেন এস এম শাহনূর
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের দক্ষিণ মৌড়াইলে, এ গফুর রোডে আলোর পথে ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘর’।অসম্পূর্ণ কাজগুলোকে সম্পন্নকরণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ঐকান্তিক ইচ্ছার কমতি নেই।ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘর উদ্বোধনের প্রহর গুণছে আজ। ইতিহাস বিনির্মাণের পথ হচ্ছে প্রশস্ত। এবার শুধুই একটি জাকজমকপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতার অপেক্ষা।
এ জাদুঘর বিনির্মাণের নৈপথ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুযোগ্য জেলা প্রশাসক জনাব হায়াত উদ-দৌলা খাঁনের আন্তরিকতার পাশাপাশি রয়েছে একদল ক্লান্তিহীন সংস্কৃতিবান নিঃস্বার্থের সারথি।ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘরের স্বপ্নদ্রষ্টা শিক্ষার কারিগর, লেখক ও লোকজ সংস্কৃতির গবেষক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী স্বপনের অগ্রণী প্রচেষ্টায় কিছু শিল্প সংস্কৃতিমনা মানুষের সহযোগিতায় জাদুঘরের জন্য আহরিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ও লোকজ ইতিহাস ঐতিহ্য নির্ভর নানান মূল্যবান উপকরণ। শো কেসে কিংবা ঘরের কোণে পড়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন,লোকজ উপকরণ এবং ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে এরকম উপকরণ জাদুঘরে দান করে যে কেউ অবদান রাখতে পারবে।
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ইং, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘরের কাজের অগ্রগতি পরিদর্শনে জেলা প্রশাসক জনাব হায়াত- উদ- দৌলা খান ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক( সার্বিক) জনাব মোহাম্মদ রুহুল আমিন।
ইতোমধ্যে পাতিবোর্ডে সংযুক্ত হয়েছে লোকজ উপকরণ।এসিপি বোর্ডে লেখা হবে আরো কত কী! ৪টি কক্ষের ভেতরের দেয়ালে অসাধারণ শিল্পকর্মে শীতলপাটির ডিজাইন, বাঁশঝাড়,নদীপাড়ে কাশফুলসহ বিভিন্ন কম্পোজিশনে রূপ দেওয়া হয়েছে। সংগৃহীত ঐতিহাসিক নিদর্শন ও লোকজ উপকরণ সমূহের উপর ট্র্যাকার আলোর বিচ্ছুরণে মুগ্ধ হবে হাজারো দর্শনার্থী। গ্রন্থাগার,বাগান, সামনের মঞ্চ তৈরী,রিসিপশন কর্নার,নিদর্শন সংরক্ষণ ভিত,স্টোর রুম সজ্জিতকরণ সম্পন্ন করা হয়েছে। চারপাশে উঁচু বৃক্ষরাজি,পুকুর, বিশাল মাঠ কী নেই এখানে?
সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ থেকে লোক- সংগীতের সম্রাট অমর পালসহ অসংখ্য কবি,লেখক,গবেষক, রাজনীতিক, বাদক,শিল্পী, গায়ক, নায়কদের জন্ম দিয়েছে এ জেলা।ব্রিটিশ বিরোধী আন্দলোনে বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত শতশত বীরের জন্ম হয়েছে এখানে।৫ হাজারের উপর মুক্তিযোদ্ধার জন্ম এ জেলায়। এ জেলায় সংস্কৃত পণ্ডিতদের পাণ্ডিত্য সাড়ে তিন শত বছরের আর দেড় হাজার বছর আগে থেকে মঙ্গোলীয় ও অসিরীয়দের বসবাস ছিল।পুতুলনাচ,যাত্রাপালা,নৌকাবাইচ, সার্কাসের আতুরঘর, ছোট ছোট হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম পল্লি নিয়ে গড়ে উঠা সুলতানি ও মোগল আমলের মরণজয়ী লড়াকু মানুষের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সংখ্যা বেশী নয়। তবু ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘরকে নিয়ে স্বপ্ন চাঁদ তারা খঁচিত এক আকাশ আমাদের।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘরের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রধান সমন্বয়ক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী স্বপন বলেছেন,
“আমরা আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাসকে সংগ্রহ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘরে সংরক্ষণ,বিকাশ ও প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিতে চাই।কাজটি সহজ নয়।সঠিক পরিকল্পনা,যথাযথ সিদ্ধান্ত, মানুষের ঐক্য, মেধার সংবদ্ধতা, চিন্তার প্রসারণ, উদার মনোভাব, ত্যাগ ছাড়া মহৎ ও বৃহৎ কাজ করা যায় না।একদিন যা স্বপ্ন ছিল, আজ তা বাস্তব।”
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘরে সংরক্ষণের জন্য লোকজ উপকরণ ও ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে এমন সব উপকরণ প্রদান করে যিনি কিংবা যাঁরা নিজেকে জাদুঘরের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন তাঁদের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় (ধারাবাহিক ভাবে) তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
➤ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘরের জন্য গৃহীত সম্পদের নাম ও বিবরণ:
দুটি দোতারা, একটি বেহালা, একটি ভায়োলিন বাক্স, একটি মুক্তিযুদ্ধের পুস্তিকা,ওস্তাদ অমিয় ভূষণ চক্রবর্ত্তী ও ওস্তাদ জারু মিয়ার দুটি ছবি।
➤ জাদুঘরে সংরক্ষণের কারণ:
৫২৭২ আসন বিশিষ্ট ইংল্যান্ডের রয়েল এলবার্ট কনসার্ট হল। এটি ইংল্যান্ডের সংস্কৃতির আভিজাত্যের এক অমোঘ অংশ। ১৯৮২ খ্রি.সেই রয়েল এলবার্ট হলে কিংবদন্তি বাউল শিল্পী ওস্তাদ অমিয় ভূষণ চক্রবর্ত্তী,ওস্তাদ জারু মিয়াসহ ৭জন বাংলাদেশি মাসব্যাপী অনুষ্ঠানে গান গেয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। বাংলাদেশের শ্রীবৃদ্ধি করেছেন। কুড়িয়েছেন সম্মান। বাজিয়েছেন এই দুতারা যা লন্ডনে ক্রয়কৃত। এখন এটি ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ।
➤দাতার নাম /পরিচয়:
ওস্তাদ শ্রী চরণ দাস,রাধু চক্রবর্তী,শিল্পী কিশোর চক্রবর্ত্তী,জেঠাগ্রাম,নাসিরনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।তাঁরা সকলেই অমিয় ঠাকুর ও জারুমিয়া বাউল সংগঠনের সদস্য।
➤নৈপথ্যে:
জহিরুল ইসলাম চৌধুরী স্বপন ও
সৈয়দ সালাউদ্দিন মুকুল
➤গ্রহীতার নাম/পরিচয়:
জনাব মোহাম্মদ রুহুল আমিন
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক( সার্বিক),ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কিউরেটর-ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘর।
➤গ্রহণের তারিখ:
২৪ মার্চ(বুধবার) ২০২১ ইংরেজি।
➤ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘরের জন্য গৃহীত সম্পদের নাম ও বিবরণ:
২৫০ বছরের পুরাতন পাথর বাটি;শত বছরের অধিক রুপার লাঠি।
➤ জাদুঘরে সংরক্ষণের কারণ:
তিতাসের দক্ষিণ পাড় সবুজের সমারোহ মহিউদ্দিনগরের দক্ষিণে কিলোদুয়েক পথ একদা মৎস্যজীবীদের অভয়ারণ্য ছিল। সনাতন সম্প্রদায়ের এ গ্রামের নাম মধুপুর। পশ্চিমের বিস্তৃত বিলের মধ্যে জেগে আছে প্রকৃতির অনন্য শোভিত আরেকটি গ্রাম জিদ্দিনগর। যে গ্রামের সকলেই সনাতন সম্প্রদায়ের। মধুপুরের বাদল দাসের বাড়ি সনাতন সম্প্রদায়ের একটি আখড়াভিত্তিক(মন্দির) ছিল। আশ্রমের জন্য এটি তার বাবা দান করে গেছেন।। তার বাবা ছিলেন সনাতন সম্প্রদায়ের একজন সাধক। তাঁরই পূর্বপুরুষের ব্যবহৃত ২৫০ বছরের পুরাতন পাথর বাটি ও একটি শতবছরের অধিক পুরাতন রুপার লাঠি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘরে শ্রীবৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
➤দাতার নাম/পরিচয়:
ডা.বাদল চন্দ্র দাস,মধুপুর,
আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
➤নৈপথ্যে:
ফেরদৌস রহমান
➤গ্রহীতার নাম /পরিচয়:
জহিরুল ইসলাম চৌধুরী স্বপন।
➤গ্রহণের তারিখ:
২৩ মার্চ ২০২১ইংরেজী।
➤ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘরের জন্য গৃহীত সম্পদের নাম ও বিবরণ:
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১২০টি দুর্লভ তাম্র,পিতল মুদ্রা।
➤ জাদুঘরে সংরক্ষণের কারণ:
দুর্লভ এই মুদ্রাগুলো জাদুঘর দর্শনার্থীদের বহুমাত্রিক জ্ঞান বিতরণে ভূমিকা রাখবে।
➤দাতার নাম/ পরিচয়:
এম.এ রাকিব, ফুলবাড়িয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে নব্বই দশকের কারানির্যাতিত নেতা, উদীচী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সংসদের সাবেক সভাপতি, সাবেক জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর, কৃষক সমিতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কমিটির সম্মানিত সাধারণ সম্পাদক।
➤সংগ্রাহকের নাম/পরিচয়:
ফেরদৌস রহমান।
➤গ্রহণের তারিখ:
২১ মার্চ ২০২১ইংরেজী।
➤ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘরের জন্য গৃহীত সম্পদের নাম ও বিবরণ:
১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন পাকিস্তানি আর্মিদের ব্যবহৃত চায়ের একটি কেটলি ও শরণার্থী শিবিরে ব্যবহৃত সিলভারের তিনটি থালা।
➤নিদর্শনের ধরন:
মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক নিদর্শন
➤ জাদুঘরে সংরক্ষণের কারণ:
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আব্দুল হক(বাসু দারোগা)। ১৯৭১ খ্রি. যুদ্ধের সময় তিনি ২নং সেক্টর হাপানিয়া ক্যাম্প (ত্রিপুরা,ভারত) স্টোরকিপারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া যুদ্ধের সময় তিনি মুক্তিযুদ্ধে গোয়েন্দা দপ্তরেও সম্পৃক্ত ছিলেন। যুদ্ধের আগে পাকিস্তানি পুলিশের মৌলভীবাজার, কুলাউড়ার দারোগা ছিলেন (যিনি বাসু দারোগা নামে পরিচিত)।কুলাউড়া থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তানি শাসক তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন এবং গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।১৯৭১ খ্রি. মুক্তিযুদ্ধের সময় তেলিয়াপাড়া যুদ্ধে পাকিস্তানি আর্মিদের ব্যবহৃত চায়ের গেটলি নিজের অধিকারে নিয়ে নেন। এই কেটলিতে ১০ লিটার পানি ধারণ ক্ষমতা ছিলো।
তিনি হাপানিয়া ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকাকালীন বাংলাদেশ থেকে ভারতে শরণার্থীদের যে সিলভারের থালায় খাবার পরিবেশন করা হতো তাও তাঁর সংগ্রহে রেখেছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর বড়ো মেয়ে রেবেকা চৌধুরীর সংরক্ষণে রেখে ছিলেন।
➤দাতার নাম / পরিচয়:
রেবেকা চৌধুরী (আলেয়া)
সৈয়দাবাদ,কসবা ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
তিনি বীরমুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আব্দুল হকের (বাসু দারোগা) বড় মেয়ে।একজন বোদ্ধা রবীন্দ্র পাঠিকা। তাঁর স্বামী বাঞ্ছারামপুর কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন।তিন সন্তানের মধ্যে এক ছেলে দুটি মেয়ে সকলেই জাপানে প্রতিষ্ঠিত।
➤সংগ্রাহকের নাম /পরিচয়:
জহিরুল ইসলাম চৌধুরী স্বপন ও ফেরদৌস রহমান।
➤গ্রহণের তারিখ:
২১ মার্চ ২০২১ইংরেজী।
➤ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘরের জন্য গৃহীত সম্পদের নাম ও বিবরণ:
বিশ্বের বহু দেশের মুদ্রা, টাকা ও শতাধিক দেশের ডাকটিকিট।
➤নিদর্শনের ধরন:
দূর্লভ সংগ্রহ
➤দাতার নাম/ পরিচয়:
পাঁপড়ি পাল ও স্বপন পাল।
➤সংগ্রাহকের নাম পরিচয়:
ফেরদৌস রহমান।
➤গ্রহণের তারিখ:
২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২১ইংরেজী।
➤জাদুঘরের অবস্থান:
এ গফুর রোড,দক্ষিণ মোড়াইল,বিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন (পুরাতন কাচারি অফিস),ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
➤কিভাবে যাবেন:
রেলস্টেশন থেকে পাঁচ মিনিটের পথ। কাউতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে রিক্সা যোগে সময় লাগবে মাত্র ৫ মিনিট।
☞এস এম শাহনূর
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক