| ১৬ মে ২০২২ | ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ
কালের আবর্তে বিলিন হয়ে যাওয়া কাইতলা জমিদার বাড়ির মূল জমিদার বিশ্বনাথ রায় চৌধুরীর তিন পুত্রের মধ্যে ঈষাণ রায় চৌধুরী ছিলেন সর্ব কণিষ্ঠ। আর এই ঈষাণ রায় চৌধুরীর পুত্রই ছিলেন যজ্ঞেশ্বর রায় চৌধুরী। যাঁর স্ত্রীর নাম ছিলো সুখময়ী দেবী রায় চৌধুরী (যাঁর নামানুসারে ‘সুখ সাগর’ নামে দীঘি)। এই যজ্ঞেশ্বর ও সুখময়ী দম্পতি ছিলেন নিঃসন্তান। তবে প্রফুল্ল রায় চৌধুরী নামে তাঁদের একজন পোষ্যপুত্র ছিল। পালকপুত্র হয়েও পিতার স্মৃতিকে অমর করে রাখতে ১৯১৮ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি প্রফুল্ল রায় চৌধুরী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয় শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী কাইতলা যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়। (অবশ্য শুরুতে এটি ইংলিশ মাইনর স্কুল নামে পরিচিত ছিল।) [১] সংস্কৃতির রাজধানী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুধিজনের কাছে এটি নবীনগর উপজেলার পূর্বাঞ্চলের বাতিঘর নামে পরিচিত। শতবর্ষী প্রাচীন এই বিদ্যালয়ের বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের একজন শিক্ষার্থী হিসাবে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করছি। খাতার পাতায়,বইয়ের মলাটে কত শতবার কাইতলা যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম লিখেছি তা বলা মুশকিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, স্কুলের দেওয়ালে, অফিস কক্ষের অভ্যন্তরে, সাইনবোর্ড কিংবা বিভিন্ন ফলকে যজ্ঞেশ্বর বানানের ভিন্নতা এখনও দৃশ্যমান। কিন্তু সঠিক বানান কোনটি? একশত বছর পরেও ভুল লিখি,ভুল বুলি বলি নাতো? “কাইতলা গ্রামের নামকরণের ইতিকথা”য় কাইতলা বানান/ নামের ব্যুৎপত্তি ও ইতিহাস পর্যালোচিত হয়েছে। [২] এবার কাইতলা যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ের যজ্ঞেশ্বর বানানে চন্দ্রবিন্দু আছে কী নেই? থাকলে শব্দের কোথায় বসবে এতদ বিষয়ে সবিস্তারে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। দীর্ঘ লেখা পড়তে আপনার ভালো নাও লাগতে পারে। নিশ্চিত করে বলছি, আমার ভালো লাগবে। কারণ শিক্ষা জীবনের একটি বিশেষ ও দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি এখানে। এখানকার শিক্ষাই আমাকে দেশ বিদেশের ভিন্ন জাতি ও নানান ভাষাভাষী মানুষের মাঝে অভিযোজন ক্ষমতা দিয়েছে। মাস দুয়েক আগের কথা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে অধ্যায়নরত উক্ত বিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন অনুজ আমাকে কাইতলা যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ের একাধিক ভিন্ন ছবি পাঠায়।যেখানে যজ্ঞেশ্বর বানানে ভিন্নতা স্পষ্ট! সেই অনুসন্ধিৎসু যজ্ঞেশ্বরিয়ানের জিজ্ঞাসা “কোনোটাতে ৺ (চন্দ্র বিন্দু) নেই আবার কোনোটাতে থাকলেও ৺ (চন্দ্র বিন্দু) এর অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। কোনোটাতে যঁজ্ঞেশ্বর আবার কোনোটাতে যজ্ঞেঁশ্বর। কাইতলা যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়-এর ‘যজ্ঞেশ্বর’ বানান নিয়ে আপনার থেকে একটা পোস্ট আশা করছি।” আকাশে চাঁদ না উঠলে চন্দ্র বিন্দু খোঁজে পাওয়া মুশকিল। সুপ্রিয় পাঠক, আসুন আগে ‘চন্দ্রবিন্দু’র বিন্দু বিসর্গ বিষয়ে জেনে নিই।
বাংলা বর্ণমালায় একটি ছোট পরাশ্রয়ী বর্ণ বা ছোট চিহ্ন হলো চন্দ্রবিন্দু(৺)। এটি একটি বৈশিষ্ট্যসূচক বা ধ্বনিনির্দেশক চিহ্ন যা দেখতে একটি অর্ধচন্দ্র (অর্ধেক চাঁদ) আকারের উপর বিন্দুর ন্যায়। এই বর্ণটি স্বাধীনভাবে কোনো বাংলা শব্দে ব্যবহৃত হয় না। অন্য বর্ণের আশ্রয়ে এই বর্ণটি উপস্থাপিত হয়, তাই একে পরাশ্রয়ী বর্ণ বলা হয়। এর উৎস সংস্কৃত ভাষা ও ব্রাহ্মী লিপি থেকে এবং এর ব্যবহার দেবনাগরী, বাংলা, গুজরাটি, ওড়িয়া, তেলুগু ও জাভানীয় লিপিতে। এই চিহ্নের অর্থ পূর্বের স্বরধ্বনিটি আনুনাসিক (“নাকা”) হবে।
বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান এ
স্বরবর্ণের শেষাংশে এবং ব্যঞ্জনবর্ণের আগে ং /অনুশশার্ /; ঃ /বিসর্গ / ও ঁঁ /চন্দ্রবিনদু / এর ভুক্তি রয়েছে। বইটির ২৫১ পৃষ্ঠায় ঁ চন্দ্রবিন্দু’র ভুক্তিতে বলা হয়েছে,
ঁ /চনদ্রোবিনদু/ <——–উচ্চারণ ঁ চন্দ্রবিন্দু অনুনাসিক ধ্বনির প্রতীক। এটি কেবল স্বরবর্ণ বা স্বরের সাথে যুক্ত হয় ( দন্ত > দাঁত, বন্ধন > বাঁধন)। চন্দ্রবিন্দু কখনো ম্ এর রূপও ধারণ করে (ওঁ > ওম্)। [৩]
শহিদ মিনারে স্থাপিত নামফলক।
ভারতীয় বাংলা অভিধান অমরকোষ -এ চন্দ্রবিন্দু
অর্থ : চন্দ্রের উপর বিন্দু লাগানো চিহ্ন যা কোনও অনুনাসিক বর্ণের উপর লাগানো হয়।
উদাহরণ : “চাঁদ-এ ‘চা’-এর উপর লাগানো চিহ্নকে চন্দ্রবিন্দু বলা হয়।”
বাংলা একাডেমি বাঙলা উচ্চারণ অভিধান [পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ (১৯৯৯)-এর নবম পুনর্মুদ্রণ (২০১৬)] থেকে চন্দ্রবিন্দু , ‘যার ইংরেজি নাম moon-dot’। এ – ধ্বনির ভূমিকা প্রসঙ্গে মুহম্মদ আবদুল হাই – এর মন্তব্য :
“ বাঙলায় স্বরধ্বনিকে সানুনাসিক করার চিহ্ন ( ‘৺ ) চন্দ্রবিন্দু ; ইংরেজি নাম moon – dot । ” এ – সব অনুনাসিক স্বরধ্বনি উচ্চারিত হয় নাক ও মুখের মিলিত দ্যোতনায় ( ” Combined resonance of nose and mouth ” ) । একে অনেকে ‘ নাকিসুরে উচ্চারণ বলে থাকেন । বাঙলাদেশের সর্বত্র এ – উচ্চারণ নিখুত হয় না ( এমনকি বহু শিক্ষিত লােকেরও ) । কিন্তু এর উচ্চারণ বিকৃতি বা বিলুপ্তির জন্যে শব্দের অর্থগত বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে ওঠে ।
অফিস কক্ষের দেয়ালে লাগানো অনার্স বোর্ড।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ চন্দ্রবিন্দু-কে অনুনাসিক বর্ণ বলা হয়েছে। পাণিনি তাঁর অষ্ট্যাধ্যায়ী ব্যাকরণের অষ্টধ্যায়ের চতুর্থ পাদের ৫৮-৫৯ সূক্তে চন্দ্রবিন্দুকে সানুনাসিক হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এই সূক্তদ্বয়ে দেখানো হয়েছে কি প্রক্রিয়া ‘ং’ চন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, সংস্কৃত মতে অনুস্বার (ং) একমাত্রা বিশিষ্ট। এই ধ্বনি অর্ধ-মাত্রায় রূপ নিলে তা চন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। পাণিনি উদাহরণ হিসাবে দেখিয়েছেন কিংযুক্তম্>কিঁয্যুক্তম্, সংযন্তা>সঁয্যন্তা, সংবৎসরঃ>সঁব্বৎসরঃ ইত্যাদি।
[সংস্কৃত ‘আনুনাসিক (অনুনাসা+ইক)’ অর্থ বিশেষণে— নাকের সাহয্যে উচ্চারিত; যা নাকের সাহায্যে উচ্চারণ করা হয় তা আনুনাসিক। এর সমার্থক— সানুনাসিক (সহ+অনুনাসিক)। সানুনাসিক শব্দের অভিধান নির্দেশিত অর্থ বিশেষণে— নাসিকা থেকে উচ্চারিত, নাকিসুরযুক্ত।
সংস্কৃত ‘অনুনাসিক (অনু+নাসিক)’ অর্থ নাকি, খোনা, (ব্যাকরণিক পরিভাষায়) নাসিকার সাহায্যে উচ্চার্য (অনুনাসিক বর্ণ, ঙ, ঞ, ন, ম, ং )।
নাকের সাহায্যে উচ্চারিত সব ধ্বনিই আনুনাসিক হতে পারে, কিন্তু অনুনাসিক ব্যাকরণিক নির্দেশনার উপর নির্ভরশীল। ] [৭]
বাংলা ও ফরাসি ভাষা শ্রবণে মধুরতার পিছনে, উভয় ভাষাতেই প্রচুর পরিমানে সানুনাসিক ধ্বনির ব্যবহার অন্যতম। এটি কোনো ভাষার সমগ্র ধ্বনিরূপকে স্নিগ্ধ করে দেয়।
বানানরীতিতে চন্দ্রবিন্দু:
বাংলা বানান রীতিতে চন্দ্রবিন্দু ঠিক কোথায় ব্যবহৃত হবে, এ নিয়ে একটা সময় সংশয় ছিল। কারণ, পুরানো বই পত্রে দেখা গেছে, এই চিহ্নটি ব্যবহারে সুনির্দিষ্ট বিধি অনুসৃত হয় নাই। ৯০ দশকের দিকে কম্পিউটারে যখন বাংলা ফন্ট উপস্থাপনের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান গবেষণা শুরু করে, তখন প্রথিতযশা কোন ভাষাতাত্ত্বিকদের ছাড়াই তাঁরা এর নিষ্পত্তি করে ফেলেছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁরা একেবারেই যে তাঁদের স্মরণাপন্ন হন নি, তা নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে ভাষাতাত্ত্বিকরা অনেক সময়ই একমত হতে পারেন নি। শেষ পর্যন্ত বাংলা ফন্ট নির্মাতারা যাবতীয় বাংলা বর্ণবিন্যাসের প্রক্রিয়াটির ক্রমোন্নয়ন করেছিলেন সহজাত অনুভব থেকে এবং এখনো অনেকে এই কাজটি করে চলেছেন। এঁদের মাধ্যমে চন্দ্রবিন্দু কোথায় উপস্থাপিত হবে তা একরকম নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। পরবর্তী সময়ে ইউনিকোডে-এর মাধ্যমে তা একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। নাসিক্য ধ্বনির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ধ্বনিলিপিতে (IPA=International Phonetic Alphabet) কোনো পৃথক চিহ্ন নেই। তবে সানুনাসিক ধ্বনির ক্ষেত্রে আছে। এর চিহ্ন হলো ̃। এর আন্তর্জাতিক লিপি সঙ্কেত 0303। এই চিহ্নটির মূল আশ্রয়স্থান স্বরবর্ণ। এই বিধিটি হলো–
১. কারবিহীন ব্যঞ্জনধ্বনির উপরে চন্দ্রবিন্দু থাকবে। যেমন– কঁ।
২. যে সকল ব্যঞ্জনবর্ণের ডানদিকে কার চিহ্ন থাকে, সে সকল ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে যুক্ত কার-চিহ্নের উপর চন্দ্রবিন্দু বসবে। যেমন– কাঁ, কীঁ।
৩. যে সকল বর্ণের কার-চিহ্ন ব্যঞ্জনবর্ণের আগে বা নিচে থাকবে, সে ক্ষেত্রে চন্দ্রবিন্দু ব্যঞ্জনবর্ণের উপরে বসবে। যেমন– কিঁ, কুঁ, কূঁ, কেঁ, কৈঁ।
৪. যে সকল কারধ্বনি ব্যঞ্জনবর্ণের উভয় দিকে বসে, সে সকল ব্যঞ্জনবর্ণের ডানদিকের কার-চিহ্নের উপরে চন্দ্রবিন্দু বসবে। যেমন– কোঁ, কৌঁ।
➤বাংলা ভাষায় সম্ভ্রম, গৌরব বা সম্মানসূচক সর্বনাম পদে (যেমন: তাঁর,ইঁহার, উঁহার, এঁদের, ওঁদের…); কয়েকটি সংখ্যাবাচক শব্দের বানানে (যেমন: পাঁচ, পঁচিশ, পঁচিশে, পঁয়ত্রিশ…); ধ্বন্যাত্মক বা অনুকার শব্দের বানানে (যেমন : উঁহুঁ, কাঁইমাই, কুঁইকুঁই,…); এবং বেশ কিছু দ্বিরাবৃত্ত শব্দের বানানে (যেমন: আঁকাআঁকি, ছোঁয়াছুঁয়ি, বাঁধাবাঁধি,…) চন্দ্রবিন্দুর আবশ্যিক ব্যবহার রয়েছে। [৮]
বাংলা বানানে চন্দ্রবিন্দুযুক্ত শব্দমাত্রই অতৎসম। তদ্ভব শব্দে অধিকাংশ চন্দ্রবিন্দু আসে সংস্কৃত/তৎসম বানানের ঙ, ঞ, ণ, ন, ম এবং অনুস্বার ( ং) বর্ণের লোপের ফলে। অর্থাৎ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তৎসম বানানের নাসিক্য ধ্বনি তদ্ভব শব্দে চন্দ্রবিন্দু রূপ লাভ করে।
যেমন:
ঙ: পঙ্ক থেকে পাঁক, অঙ্কন> আঁকা, কঙ্কন> কাঁকন, শঙ্খ> শাঁখ, বঙ্কিম> বাঁকা, পঙক্তি> পাঁতি
ঞ: পঞ্চ থেকে পাঁচ, অঞ্চল> আঁচল, অঞ্জলি> আঁজলা
ণ: ভাণ্ডার থেকে ভাঁড়ার, ভাণ্ড> ভাঁড়, কণ্টক> কাঁটা, ষণ্ড> ষাঁড়, শুণ্ড> শুঁড়, পলাণ্ডু> পেঁয়াজ, হণ্টন> হাঁটা, চণ্ডাল> চাঁড়াল
ন: স্কন্ধ থেকে কাঁধ, দন্ত> দাঁত, সন্তরণ> সাঁতার, বান্দর> বাঁদর, বন্ধন> বাঁধন, ছন্দ> ছাঁদ, চন্দ্র> চাঁদ, গ্রন্থনা> গাঁথা, বৃন্ত> বোঁটা, সন্ধ্যা> সাঁঝ, অন্ধকার> আঁধার, ক্রন্দন> কাঁদা
ম: ধূম থেকে ধোঁয়া, আমিষ> আঁষ, কম্পন> কাঁপা, ঝম্প> ঝাঁপ, চম্পক> চাঁপা, গ্রাম> গাঁ, সমর্পণ> সঁপা, গুম্ফ> গোঁফ
ং: বংশী থেকে বাঁশি, সংক্রম> সাঁকো, হংস> হাঁস, বংশ> বাঁশ
নাসিক্যধ্বনি বিলুপ্ত না হলে কী হবে?
নাসিক্যধ্বনি বিলুপ্ত না হলে চন্দ্রবিন্দু হয় না। যেমন- ঘৃণা> ঘেন্না, রত্ন> রতন, মাণিক্য> মানিক, শাল্মলী> শিমুল, গঙ্গা> গাঙ, বন্য> বুনো, মনুষ্য> মানুষ, বান্দর> বানর, যত্ন> যতন, স্বর্ণ> সোনা, কর্ণ> কান, রন্ধন> রান্না, লাঙ্গল> লাঙল, জন্ম> জনম, হাঙ্গর> হাঙর, ব্রাহ্মণ> বামুন।
ব্যতিক্রম: কখনও দেখা যায় নাসিক্যধ্বনি বিলুপ্ত হলেও চন্দ্রবিন্দু হয় না। যেমন— কঙ্ক> কাক, টঙ্কা> টাকা, কর্দম> কাদা, কৃপণ> কিপটে, লম্ফ> লাফ, ঝঞ্ঝা> ঝড়, কৃষ্ণ> কালো, শৃঙ্খল> শিকল
হিন্দু মতে চন্দ্রবিন্দু:
১. হিন্দু তন্ত্রমতে চন্দ্রবিন্দুকে বিন্দুরূপার প্রতিরূপ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই কারণে শক্তিবিগ্রহের পূর্বে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করা হয়। যেমন- শ্রীশ্রী ৺শারদীয়া পূজা।
২. হিন্দু মৃত ব্যক্তির নামের আগে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করা হয়। মৃতব্যক্তি স্বর্গগত হয়েছে বা ঈশ্বরপ্রাপ্ত হয়েছে এই বিচারে এই ঈশ্বরের প্রতীক হিসাবে চন্দ্র ব্যবহৃত হয়। যেমন- ৺রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অর্থাৎ স্বর্গীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চন্দ্রবিন্দু যে বর্ণের উপর বসে, সেই বর্ণের উচ্চারণ আনুনাসিক হয়। কেবল স্বরবর্ণ ও স্বরান্ত ব্যঞ্জনের সঙ্গে এটি যুক্ত হতে পারে।
বাংলা একাডেমি ব্যাবহারিক বাংলা অভিধান এ [পরিমার্জিত সংস্করণ ডিসেম্বর ২০০০-এর অষ্টাদশ পুনর্মুদ্রণ: মাঘ ১৪২১/জানুয়ারি ২০১৫] চন্দ্রবিন্দুর কিছু প্রয়োগ রয়েছে।
[দেবদেবীবাচক শব্দের আগে, ওঁ বা ওম্-এর সংকেত হিসাবে; এবং পরলোকগত ব্যক্তির নামের আগে, স্বর্গত (মৃত)/স্বর্গতা (মৃতা) বোঝাতে]।
বইয়ের ২০৪ পৃষ্ঠায় চন্দ্রবিন্দু’র ভুক্তির -২ এ বলা আছে;
ঁ কখনো কখনো ম্ থেকে উৎপন্ন। ওম্>ওঁ। হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রচলিত কোনো কোনো শব্দের আদিতে ঁ চন্দ্রবিন্দু দেখা যায় কিন্তু ধ্বনি হিসাবে তা উচ্চারিত হয়না।
(ক) ওঁ শব্দের সংক্ষিপ্ত বা সংকেতবাচক রূপ হিসেবে (ঁশ্রীশ্রী হরিশরণম্) ;
(খ) স্বর্গত বা স্বর্গতা(ঁকুমুদিনী দেবী) বোঝাতে শব্দের পূর্বে চন্দ্রবিন্দু বসে।
তবে দেবদেবীবাচক নামের পূর্বে ব্যবহৃত ঁ ‘ওঁ’ [ওম্] রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন: ঁগঙ্গা[ওম্ গঙগা] [৯]
যজ্ঞেশ্বর শব্দের আদি ও ইতি:
যজ্ঞেশ্বর একটি বিশেষ্য বা নাম পদ , এটিকে সন্ধিবিচ্ছেদ করলে দাঁড়ায় –
যজ্ঞ +ঈশ্বর =যজ্ঞেশ্বর।
আবার সমাসবদ্ধ পদে-
যজ্ঞের ঈশ্বর=যজ্ঞেশ্বর [ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস]
বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান -এর ১১৪১ পৃষ্ঠায় যজ্ঞেশ্বর শব্দের ভুক্তিতে নিন্মোক্ত উচ্চারণ, ব্যুৎপত্তি, পদ ও অর্থ নির্দেশিত হয়েছে।
উচ্চারণ- / জোগগেঁশশর / [ সংস্কৃত যজ্ঞ +√ঈশ্ + বর্ ] ; পদে – বিশেষ্য। অর্থ: নারায়ণ ও বিষ্ণু।
শব্দের উৎপত্তি বিবেচনায় যজ্ঞ ও ঈশ্বর দুটোই তৎসম শব্দ।
অন্য অর্থে যজ্ঞেশ্বর শব্দের অর্থ আগুন। যজ্ঞেশ্বর এর ইংরেজি অর্থ (noun): Lord of sacrifice; Vishnu.
Vishnu বিষ্ণু (সংস্কৃত: विष्णु) হিন্দুধর্মের দেবতা এবং ত্রিমূর্তির অন্যতম সদস্য, বিষ্ণু বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিপালক রূপেও পরিচিত এছাড়াও তিনি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ দেবতা। আদি শংকর প্রমুখ পণ্ডিতদের মতে, বিষ্ণু ঈশ্বরের পাঁচটি প্রধান রূপের অন্যতম।
যজ্ঞ (সংস্কৃত: यज्ञ, ‘বলিদান, ভক্তি, উপাসনা, নৈবেদ্য’) হিন্দুধর্মে পবিত্র অগ্নির সামনে যে কোনও আচারের কথা বলা হয়, প্রায়শই মন্ত্র দিয়ে।
যজ্ঞ শব্দের মূল সংস্কৃত ‘যজ’ যার অর্থ ‘পূজা করা, আদর করা, সম্মান করা, শ্রদ্ধা করা’ এবং প্রাথমিক বৈদিক সাহিত্যে দেখা যায়, যা খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে রচিত। ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ এবং অন্যদের মধ্যে এর অর্থ হল “উপাসনা, কোন কিছুর প্রতি ভক্তি, প্রার্থনা ও প্রশংসা, উপাসনা বা ভক্তি, নৈবেদ্য বা উৎসর্গের একটি রূপ, ও বলি”।
ঈশ্বর শব্দের মূল “ঈশ্” এর অর্থ হল,দক্ষ, মালিক,শাসক। দ্বিতীয় অংশ ‘বর’ যার আভিধানিক অর্থ হল “সেরা, চমৎকার, সুন্দর, শাসক”। অতএব, যুগপৎভাবে ঈশ্বর শব্দের অর্থ হল; সেরা বা সুন্দরের স্রষ্টা।
প্রাচীন এবং মধ্যযুগের সংস্কৃত ধর্মীয় বইয়ের ধারণা থেকে ঈশ্বর এর নানাবিধ অর্থ পাওয়া যায়, যেমন: সৃষ্টিকর্তা, মহান সত্তা, পরমাত্মা, প্রভু, মহাবিশ্বের শাসক, ধনী শ্রেষ্ঠী ,একাদশ রুদ্রগণের মধ্যে একজন,স্বামী,দেবতা-শিব, দয়াময় এবং রক্ষাকর্তা।
শেষ কথার আগের কথা:
যজ্ঞেশ্বর বানানে যে কয়টি কারণে চন্দ্রবিন্দু থাকবে না।
(১) আলোচ্য ‘যজ্ঞেশ্বর’ শব্দটি সংস্কৃত বা তৎসম। কোনো তৎসম শব্দে চন্দ্রবিন্দু থাকে না। যজ্ঞেশ্বর তৎসম শব্দ।
(২) অতৎসম শব্দে চন্দ্রবিন্দু তখনই বসে যখন নাসিক্য ব্যঞ্জন ধ্বনি (ঙ ঞ ন ণ ম) বানানে লুপ্ত হয়।
যেমন: জিজ্ঞাসা> জিগেঁস। অঞ্চল >আঁচল। পঞ্চ> পাঁচ
শব্দগুলোতে ঞ লোপ হয়েছে। যজ্ঞেশ্বর বানানে ঞ লোপ হয় না।
(৩) ‘যজ্ঞেশ্বর’ কে বর্ণ বিশ্লেষণ করলে হয়-
য+জ+ঞ+এ+শ+অন্তস্থব+র।
যজ্ঞেশ্বর বানানে ঞ নাসিক্য ধ্বনি বিলুপ্ত হয়নি।
(৪) হিন্দু ধর্মে মৃত্যু ব্যক্তির নামের পূর্বে স্বর্গী অর্থে একসময় ৺ চন্দ্র বিন্দু ব্যবহারের প্রচলন ছিল। কালের পরিক্রমায় তা আজ বিলুপ্ত। বাংলা ব্যাকরণে কোনো বিশেষ্য/নাম পদের সামনে কিংবা উপ-র ৺চন্দ্র বিন্দু ব্যবহারের নিয়ম রাখা হয়নি। [দ্রষ্টব্য- ৩]
➤ তথ্য ঋণ:
[১] “কাইতলা জমিদার বাড়ির ইতিহাস” নিবন্ধ।। এস এম শাহনূর। নবসাহিত্যের পাতা সামিকী। উন্মুক্ত সাহিত্য সংগঠন। প্রকাশকাল ১৯৯৮ ইং।
[২] কাইতলা গ্রামের নামকরণের ইতিকথা।। এস এম শাহনূর। ইউনিয়ন তথ্য বাতায়ন। আওয়ার কণ্ঠ।
[৩] বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান
[৪] ভারতীয় বাংলা অভিধান অমরকোষ।
[৫ ] বাংলা একাডেমি বাঙলা উচ্চারণ অভিধান [ নবম পুনর্মুদ্রণ (২০১৬)]
[৬] বঙ্গীয় শব্দকোষ। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহিত্য অকাদেমি। পঞ্চম মুদ্রণ ২০০১।
[৭] পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী। শ্রীদেবেন্দ্র কুমার বিদ্যারত্ন সম্পাদিত। বলরাম প্রকাশনী। মহালয়া, ২০০৩।
[৮] ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র।। ড.মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।
[৯]
◑ ড. মাহবুবুল হকের ‘বাংলা বানানের নিয়ম’।
◑ বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান।
[১০] বাংলা একাডেমি ব্যাবহারিক বাংলা অভিধান
[১১] কথোপকথন:
◑ মানবর্দ্ধন পাল
“ব্যাকরণের বিন্দু বিসর্গ” সহ একাধিক গ্রন্থ প্রণেতা।
◑ আশিক ইবনে সোলায়মান, বাংলা শিক্ষার্থী।
সর্বস্বত্ব: এস এম শাহনূর
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক।
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | |||||
৩ | ৪ | ৫ | ৬ | ৭ | ৮ | ৯ |
১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ |
১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০ | ২১ | ২২ | ২৩ |
২৪ | ২৫ | ২৬ | ২৭ | ২৮ | ২৯ | ৩০ |