লেখক: জহিরুল ইসলাম স্বপন | ১১ জানুয়ারি ২০২১ | ৫:৩২ অপরাহ্ণ
ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক মানিকরতন শর্মা’ র নতুন উপন্যাস- অদ্বৈত- এর মোড়ক উন্মোচন ৯ জানুয়ারি ২০২১,প্রকাশক বেহুলাবাংলা।গল্প লিখতে লিখতে আজ শর্মাজি ঔপন্যাসিক।বইটিকে শুভাশিষ জানিয়েছে কবি জয়দুল হোসেন।কালজয়ী ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ- জীবনালেখ্যভিত্তিক উপন্যাস লিখে শর্মাজি সত্যিই অদ্বৈত’র প্রতি,সাহিত্যের প্রতি একটি মহান দায়িত্ব পালন করেছে।বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ,ত্রিপুরা ও আসামের কৈবর্ত সম্প্রদায়ের প্রতি উপন্যাস উৎসর্গ করে মমত্ববোধ ও ভালোবাসার পরিচয় দিয়েছেন।অনেকদিন ধরেই শর্মাজি অদ্বৈত নিয়ে ভেবেছেন, পড়ছেন দরদ দিয়ে।তাঁর অস্থিমজ্জায়, শয়নে- স্বপনে শুধুই অদ্বৈত।আমার কষ্ট লাগছে মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বিশেষ কারণে অনুপস্থিতির জন্য।মনটা পড়ে থাকবে ওস্তাদ আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গের হলরুমে।এজন্য ক্ষমাপ্রার্থী।
১.প্রচ্ছদঃ বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন হাজ্জাজ তানিন।চিরপরিচিত ছবিটি অদ্বৈত’ র। আজও তা হালকা নীল জলে নীলবেদনা নিয়ে তিতাসের হৃদয়ের গভীরে বাস করছে।এ শুধু অদ্বৈত’ র একার কষ্ট নয়- সকল মালো সম্প্রদায়ের জীবন – সংগ্রামের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে।জাল, জল নিয়ে তাঁদের জীবন।জীবনে যাঁদের হররোজ ক্ষুধা, দারিদ্র্য,অপুষ্টি ও জন্ম-মৃত্যু।আজও সাংস্কৃতিক নদী তিতাস ও অদ্বৈত এক ও অভিন্ন।তিতাসের জল জেলেদের প্রাণ, অদ্বৈত’ র প্রাণ।উপরে জেলে পাড়া গোকর্ণের জলন্ত উনুন অদ্বৈত ও মালো নর- নারীদের জীবনযুদ্ধের আগুন।আগুন ঊর্ধ্বমুখী আজও জ্বলছে।জন্ম- মৃত্যু ও ক্ষুধা এখানে নিত্যসঙ্গী।তিতাসের শীতল জল অদ্বৈত’র শান্তি- প্রশান্তি, নির্ভরতা।শান্তির পাশেই আগুনের অশান্তি, হৃদযের অনলে জ্বলেছে, পুড়েছে, মরেছে কত সংসার।
মূলকথাঃ কবি ও লেখক শর্মা বইটিতে মালোপাড়ার রাতবিরাতের,প্রকৃতি, তিতাসের ছবি অনেক এঁকেছেন।মাঝেমধ্যে চিন্তায় দার্শনিকতার ছাপ পাওয়া যায়।
বিচিত্র ছবি- ভৈরবী গামছার নেংটি, কাঁধে সংগ্রাম মহাজনির জাল,চরণে ভাসে পুজোর ফুল,উচাটন গান্ধারি মেঘনা, নদীর চিল ডাল।বিভিন্ন উপমা উপহার দিয়েছে।পৌরাণিক শব্দ, জেলার আঞ্চলিক শব্দ, কৃষ্ণগান, লোকজ উপাদানের মিথষ্ক্রিয়ায় তাঁর উপন্যাসকে সাজিয়েছেন।ছবির পর ছবি, রঙের উপর রঙ, আমাদের নাকে জল, জাল, কাঁদার গন্ধ পাই তাঁর উপন্যাসে।
আর দার্শনিকতা! লিখেছেন- ভোর হতে শুরু করে তখনই শরীরের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে কামদেব।শুরু হয় রতিযুদ্ধ খেলা।এমন খেলায় জেলেপাড়ায় প্রতিবছর মাথার বহর বাড়ে।কিন্তু অভাব- অনটনের ব্যাপারটা কেউ সন্তান জন্মের সাথে মিলিয়ে দেখে না।বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি, গাণিতিক হিসেব তুলে ধরেছে।ভোরে কামদেব শরীরে কামনা- বাসনা জাগিয়ে দেয়।কারণ দিনে কঠোর কাজ, সন্ধ্যারাতে ক্লান্তি, ভোরে যৌনখেলা তাদের নিত্যকাজ।উপন্যাসে তিনি কঠোর পরিশ্রম করে অদ্বৈত’ র জীবনযুদ্ধ, শৈশব- কৈশোরের কাহিনি তুলে ধরেছেন বাস্তবতা ও দরদ দিয়ে।কলকাতা আর গোকর্ণের জীবনে তাঁর ক্ষুধা,কষ্ট, আর্থিক- সংকট পাঠকের হৃদয়কে কাঁদিয়েছে।ছোটবেলায় অদ্বৈত’র মা- বাবা, ভাই, ভগ্নিপতির মৃত্যুর ঘটনা হৃদয়স্পর্শী।সেলুলয়েডের ফিতেয় বন্দি করেছে ষষ্ঠীতলার ঘরে বৈশাখের ঘরে তাঁর মৃত্যু।বৃষ্টি হচ্ছে প্রকৃতির কান্না, তাঁর অব্যক্ত বেদনা অনবদ্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।
কাট কাট বাক্য।কোথাও কোথাও মহাপ্রাণ বর্ণের ব্যবহার হয়েছে।আবার ও- কারান্ত শব্দে ব্যবহার এ জেলায় হয় না। তা ব্যবহৃত হয়েছে।
১২ পৃষ্ঠায় দাঁড়িওয়ালা জেলে বলে ওঠে নদীর জীবনকথা।আমি দেখছি, লেখক নিজের মুখে তা বলেছেন।যদি নাতিদীর্ঘ নদীর বর্ণনা জেলের মুখে শুনতাম ভালো হত ১৩ পৃষ্ঠায় নদীর কথা নয়।এসেছে জমি,সরিষার ফুল, জামাই- বউয়ের চলনভঙ্গীর বর্ণনা।
অদ্বৈতের জীবনে আরও অবহেলা ছিল।তাঁর জীবন মানস গঠনের কার্যকারণগুলো একটু কম এসেছে।বাউনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী, বিপ্লবীচেতনা, তাঁর বইযের সিলেকশান আসে নি।তিনি কীভাবে অসাম্প্রদায়িক মানুষে রূপান্তরিত হয়ে উঠেন, তাঁরও একটি চিত্র তুলে ধরা যেত ।লোকজ তথ্যসংগ্রহ করেছেন জেলে ও কৃষক জীবন থেকে যা তাঁর সংগৃহীত।সম্ভবত অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন তাঁর কালীবাড়িতে বক্তব্যটি এমন- দেশে আজ ঘরে ঘরে ইন্দ্রনাথের মতো চরিত্র দরকার।সালটি ১৯৩০ হতে পারে।তখন বিপ্লবী আন্দোলন জেলায় তুঙ্গে।প্রতিটি গ্রাম- শহরের স্কুলে স্বদেশীদের আন্দোলন চলছে।ঔপন্যাসিক শর্মাজি বিষয়টি শুরু করেন তাঁর দ্বিধা- দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে তা সঠিক।কিন্তু অদ্বৈত’ র মনের পরিপক্বতা তুলে ধরলে আরও ভালো হত।কলকাতার জীবন আমার কাছে সংক্ষিপ্ত মনে হয়েছে।পাঠের দুঃখ নয়, লেখকের হৃদয়ের কান্না সংক্ষিপ্ত করতে গিয়ে চরিত্র সংলাপ ছোট করেছেন।অদ্বৈত মিতভাষী ছিল। কিন্তু সাগরময় ঘোষ, সুবোধদা, শুভঙ্কর এঁদের ভেতর দিয়ে সংলাপ ও চরিত্র শক্তিশালী করা যেত।পাশের চরিত্রগুলো মূল চরিত্র উপর প্রভাব ফেলে।তা ছাড়া তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে প্রেম এসেছে ভিন্ন মাত্রায়, কত গভীরতায়।কিন্তু আমাদের মানিকের উপন্যাসে তা একেবারে নেই।তিতাসে অদ্বৈত’ র জন্য একজন কিশোরীর প্রতীক্ষার স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে
অদ্বৈত’ র জন্য লেখকের পরিশ্রম অনেকাংশে সফল।এটি সবার হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করবে বহুমাত্রিকতায়।লেখক বড় একটি কাজ করেছেন। বহু কথা বলার ছিল।কিন্তু ছোট করেই বলতে হবে।মানিকরতন শর্মা জেলে নন।তবে জেলে জীবন ও তাঁদের সংস্কৃতিকে আত্মস্থ, মনস্থ করেছেন ভালোবাসা দিয়ে।উপন্যাসটি অসাধারণ হত যদি চরিত্র নির্মাণে আর একটু যত্নশীল, চিত্র অংকনে পাকা হাত হওয়া সত্ত্বেও কোনো কোনো জায়গায় সংক্ষিপ্ত করেছেন।তারপরও বলতে হয যেখানে যে গান সংযোজন করা প্রয়োজন তাতে সতর্ক তিনি।মালোপাড়ার অন্যদের চরিত্র, দ্বন্দ্বগুলো এলে উপন্যাস আরও নান্দনিক হত।
তিনি আমাদের জেলা তথা সাহিত্যাকাশে নতুন একটি উপন্যাস দিয়েছেন।প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন, অদ্বৈতের এ কাহিনি পড়ে পাঠক বিমুগ্ধ না হয়ে পারে না।মানিক রতন হয়েছে রতন তো মানিক।বইটি পাঠকমহলে জনপ্রিয়তা পাবে ব্যাপক।শুভকামনা শর্মাজি।আমি দুঃখিত সহধর্মিনীর চক্ষুদ্বয়ের অবস্থা ভালো নয়।অন্ধত্বের দিকে যাচ্ছে। চিকিৎসা জরুরি।সবাইকে শুভেচ্ছা।
কলমে:
জহিরুল ইসলাম স্বপন
(লেখক ও গবেষক)