| ২৫ আগস্ট ২০১৮ | ৪:৫০ পূর্বাহ্ণ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ‘নবীনগর’ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী গ্রাম “কাইতলা” তে অবস্থিত এই জমিদার বাড়িটি।
বর্তমানে এটি এলাকাবাসীর কাছে ঐতিহাসিক “বড় বাড়ি” নামে পরিচিত।
জানা যায় যে,কাইতলা গ্রামটি একসময় ত্রিপুরা রাজ্যের সবচেয়ে বড় জমিদারি সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল।
আরো জানা যায় যে,দু’শো বছর পূর্বেও ত্রিপুরা রাজার আমলে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের একটি পূর্ণাঙ্গ জমিদার বাড়ি ছিল।
ব্রিটিশ শাসনামলে “ত্রিপুরা” রাজ্যের অধীন বৃহত্তর কুমিল্লার শাসক ছিলেন ত্রিপুরার রাজা “বিরেন্দ্র কিশোর মানিক্য”।১৩১৯ সাল থেকে ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত ২৪ জন রাজা বৃহত্তর কুমিল্লার ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ শাসন করেন।এই রাজাদের অধীনেই ছিলেন জমিদাররা এবং জমিদারদের অধীনে ছিলো তালুকদাররা।
১৮ শ শতকের প্রথম দিকে নির্মিত হয় এই জমিদার বাড়িটি।
ব্রিটিশ শাসনামলে এখানকার জমিদারদের বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এবং তারা বেশ প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন।
জানা যায়,তৎকালীন সময়ে কাইতলার মূল জমিদার ছিলেন “বিশ্বনাথ রায় চৌধুরী”।পশ্চিমবঙ্গের “শিম গাঁও” নামক স্থান থেকে এখানে এসে বসতি স্থাপন করেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
ওনার পর ওনার তিন ছেলে পরবর্তীতে জমিদারি তদারকি করেন।
তারা হলেনঃ
-তিলক চন্দ্র রায় চৌধুরী,
-অভয় চন্দ্র রায় চৌধুরী এবং
-ঈশান চন্দ্র রায় চৌধুরী।
তবে কারো কারো মতে মূল জমিদার ছিলেন “বাবু প্রফুল্ল চন্দ্র রায় চৌধুরী”।তাদের মতে জমিদারের তিন সন্তানরা হলেনঃ
-বাবু অভয় রায় চৌধুরী,
-বাবু ঈশান রায় চৌধুরী এবং
-বাবু যঁজ্ঞেশ্বর রায় চৌধুরী।
জানা যায়,নিঃসন্তান তিলক চন্দ্র রায় চৌধুরীর পর জমিদারি পান আরেক নিঃসন্তান অভয় চন্দ্র রায় চৌধুরী।তিনি অনেক জনহিতকর কাজ করেছেন বলে জানা যায়।তার নামে কসবার বল্লভপুর গ্রামের পশ্চিমাংশ ‘অভয় নগর’ নামে পরিচিত।
তারপর জমিদারি পান ঈশান চন্দ্র রায় চৌধুরী।জানা যায়,তিনিও অনেক জনহিতকর কাজ করেছেন।এই জনহিতকর কাজের জন্য আজও গ্রামবাসীর নিকট স্মরণীয় তিনি।তার স্মৃতি রক্ষার্থে তার নামে কসবার ‘মেহারী ইউনিয়ন’ এর একটি গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে “ঈশান নগর”।
জানা যায়,ঈশান চন্দ্র রায় চৌধুরীর একমাত্র পুত্র সন্তান ছিলেন “যঁজ্ঞেশ্বর রায় চৌধুরী”।পিতার মৃত্যুর পর জমিদারি পান তিনি।কিন্তু তখন জমিদারী ও ঐশ্বর্যে ভাটা ছিল।দুর্ভাগ্যক্রমে তিনিও নিঃসন্তান ছিলেন।তার পালকপুত্র ছিল “প্রফুল্ল চন্দ্র রায় চৌধুরী”।
পালকপুত্র হয়েও গ্রামের অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষদের জন্য গ্রামের দক্ষিণে বাবার নামে ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি মাইনর স্কুল।বর্তমানে স্কুলটির নাম “কাইতলা যঁজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়”।আজ এটি একটি মাধ্যমিক স্কুল এবং ১৯৯৭ সাল থেকে এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র।বর্তমানে এটি জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী এবং স্বনামধন্য স্কুল।
পালকপুত্র প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তার মাতা (যঁজ্ঞেশ্বর রায়ের স্ত্রী) “সুখ মনি রায় চৌধুরানী ওরফে সুখ দেবী” এর স্মৃতিকে ধরে রাখতে গ্রামের উত্তর-পশ্চিমে ৪০ একর আয়তন বিশিষ্ট একটি দীঘি খনন করেন এবং মায়ের নামানুসারে নাম রাখেন “সুখ সাগর”।
এই জমিদার বাড়ির সর্বশেষ জমিদার ছিলেন “অতীন্দ্র মোহন রায় চৌধুরী”।এলাকার মানুষের কাছে তিনি “হারু বাবু” নামে পরিচিত ছিলেন।তিনি ‘কাইতলা যঁজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়’ এর কল্যাণে কাজ করে গেছেন।তিনি ২০০৩ সালে মারা যান।কারো মতে,মৃত্যুসালটা ২০০১।
জমিদার বাড়িটিতে রয়েছে নাচমন্দির,স্বর্ণমন্দির,শয়নকক্ষ,অন্দরমহল,কয়েদখানা প্রভৃতি।
এর প্রবেশপথে রয়েছে বাঘ,সিংহ,সাপ,ড্রাগন ও লতা-পাতার কারুকার্যখচিত দ্বার।স্থানীয়রা একে “বড় বাড়ির গেইট” বলেন।
গেট পেরিয়ে বড় বাড়ির নাচমন্দির,তার পাশে মাঠ।মাঠের উত্তরে নাচমন্দিরের সামনে সিঁড়ি।মাঠের দক্ষিণে ছিল সুসজ্জিত বৈঠকখানা এবং তার পাশে ছিল জমিদারদের প্রশাসনিক কার্যালয়ের ইমারত খানা।এটি কিছুকাল পূর্বেও সাব পোস্ট অফিস কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
মাঠের পূর্বদিকে রয়েছে দু’দিকে শানবাঁধানো পাঁকা ঘাট সংবলিত এ এলাকার সবচেয়ে বড় দীঘি।একটি ছোট মঠও ছিল পূজা-অর্চনার প্রয়োজনে।
মাঠের পশ্চিমে ছিল বিরাট প্রাসাদ ও কয়েদখানা।বাড়িটি যে একটি পূর্ণাঙ্গ খানদানী বাড়ি ছিল তার প্রমাণ এই কয়েদখানা।
মাঠের উত্তরদিকে রয়েছে একটি পুরনো,ভগ্ন তিনতলা ভবন;মাঝে ছোট রাস্তা।এখানে রয়েছে অন্দরমহল ও অন্যান্য কক্ষ এবং সুখমণী রানী দেবীর বিশ্রামাগার ও প্রমোদ ভবন।এর উত্তর-পূর্বে দাস-দাসীদের কক্ষ।ভেতরের দিকে রয়েছে পূজোর ঘর,পারিবারিক বৈঠকখানা।এছাড়াও রয়েছে নানান কক্ষ।
মূল বাড়ির সামান্য পশ্চিমে পাশাপাশি দু’টি পুকুর।তারমধ্যে একটি পুকুর শত শত বছরেও খনন করা সম্ভব হয়নি।সারাবছর ঘাসে আবৃত থাকতো,নাম-“আন্ধা পুকুর”।
জানা যায়,জমিদাররা তাদের মূল্যবান স্বর্ণালংকার ও হীরা জহরত কলসিতে ভরে পুকুরে ডুবিয়ে রাখতো।মাঝে মাঝে ভেসে ওঠতো বলে জানা যায়।সিন্দুক ভেসে ওঠার কথাও শুনা যায়।রাত্রিতে এক পুকুর থেকে আরেক পুকুরে যাওয়া-আসা করতো স্বর্ণ,রূপা,হীরা,জহরত ভর্তি তামার পাতিল-এমন নানান কল্পকাহিনী শুনা যায় এই জমিদার বাড়িকে কেন্দ্র করে।
জানা যায়,অন্যান্য জমিদারদের মতো এই এলাকার জমিদাররাও প্রজাদের উপর অনেক নির্যাতন চালাতো।প্রজারা তাই গরুর খাঁটি দুধ,টাটকা মাখন,ঘি,তরীতরকারী পাঠিয়ে খুশি রাখতো।নব বধূকে পালকীতে চড়িয়ে,ছাতা কিংবা টুপি মাথায় দিয়ে,জুতা পড়ে কেউ জমিদার বাড়ি ঘেঁষতে পারতোনা।হাতির পিঠে চড়ে বাড়ি গিয়ে খাজনা আদায় করা হতো।না পেলে বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হতো।
১৯৫০ সালে ভারতবর্ষে জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি ঘটলেও তার বহু পূর্বেই কাইতলার জমিদারদের হাত থেকে প্রজারা পরিত্রাণ পেয়েছিল বলে জানা যায়।
জমিদার বাড়ির প্রায় প্রতিটি ভবনই দারুণ সব কারুকার্যখচিত ছিল।ফুল,পাখি,লতা-পাতা,বাঘ,সাপ,ড্রাগনের অপূর্ব সব নক্সা আঁকা ছিল।
কালের বিবর্তনে সেই ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়িটি আজ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে তবুও এলাকার মানুষের কাছে আজও অাকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে এই জমিদার বাড়িটি।
বর্তমানে এখানে জমিদার বাড়ির তিনটি ভগ্ন,শ্যাওলা ঢাকা প্রাসাদ,একটি দিঘী ও আন্ধা পুকুর নামে একটি জলাশয় রয়েছে।
১৯৯৮ সালে লেখক ও গবেষক “এস এম শাহনূর” প্রিন্টিং ম্যাগাজিনে “স্মৃতির পাতায় কাইতলা জমিদার বাড়ী” শিরোনামে একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখেছিলেন।এই পোস্টের ৯০-৯৫% তথ্যই ওনার গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে এবং এখানকার ৯০-৯৫% তথ্যই প্রবন্ধটিতে ছিল।এটি বিভিন্ন সাময়িকীতে একাধিকবার প্রকাশিত হয়েছিল।এতে তার মোহ বাড়ে এবং জমিদার বাড়ির আরো তথ্য সংগ্রহ করেন।পরবর্তীতে ১৫/১২/২০১৬ তে বন্ধুর সাথে বেড়াতে গিয়ে জমিদার বাড়ির ভগ্নদশা দেখে আবার জমিদার বাড়িটি নিয়ে লেখেন এবং আহবান জানান বাড়িটি সংরক্ষণের।
কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি কর্তৃপক্ষ থেকে।এই ভগ্ন বাড়িটির যা এখন আছে,তা সংরক্ষণ করা গেলেও ঐতিহ্য রক্ষা হবে এবং বাঁচবে মূল্যবান এই বাড়িটি ধ্বংসের হাত থেকে।
আজও পর্যটকরা ছুটে যান কাইতলার ঐতিহ্যবাহী,ভগ্নপ্রায় এই জমিদার বাড়িটি দেখতে।
[তথ্যসূত্রঃ”Kaitala Nabinagar কাইতলা নবীনগরঃএস এম শাহনূর (লেখক ও গবেষক)”,”উইকিপিডিয়া” ও “ব্রাহ্মণবাড়িয়া তিতাস ইউনিয়ন বাহরাইন”।
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ”ব্রাহ্মণবাড়িয়া তিতাস ইউনিয়ন বাহরাইন” ও ” Ananta Paul”]