| ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | ৬:৩৩ অপরাহ্ণ
সত্তরের দশকে সৌদি আরবের তেল শিল্প যখন ফুলেফেঁপে ওঠে, তখন দেশটিতে বিপুলসংখ্যক বিদেশী কর্মীর ঢল নামে। এ স্রোতে ছিল মোহাম্মদ ইকবালও।
একে তেলের রমরমা বাজার; অন্যদিকে সৌদি সরকারের উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন পরিকল্পনা—এ রাজ্যটিতে বিপুল কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে। যার সুবাদে এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে কর্মীরা সেখানে কাজ করতে যান। অবশ্য বেশির ভাগ কাজের চুক্তিই ছিল স্বল্পমেয়াদি। দীর্ঘ এ সময়ের ব্যবধানে সৌদি সরকারের অগ্রাধিকারমূলক কার্যক্রমে পরিবর্তন এসেছে এবং বিদেশী শ্রমবাজারে তাদের নিয়ন্ত্রণ আরো কঠোর হয়ে উঠেছে। নানা পরিবর্তন, উত্থান-পতনের মধ্যেও ইকবাল এখানে থেকে গেছেন, নিজের তিনটি সন্তানকে বড় করেছেন এবং এ কয়েক দশকে বিভিন্ন খাতে কাজ করেছেন।
তবে সম্প্রতি সৌদি সরকারের নীতিমালায় যে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে, তাতে ৬০ বছর বয়সে সবকিছু নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে ইকবালকে। তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে সৌদি সরকার অর্থনীতি বহুমুখী করার উদ্যোগ নিয়েছে। বিদেশীদের পরিবর্তে স্থানীয়দের নিয়োগ বাড়াতে উদ্যোগী হয়ে উঠেছে সৌদি সরকার। শুধু তা-ই নয়, বিদেশী শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীলদের ওপর ফি আরোপ করেছে এবং কোন ক্ষেত্রগুলোয় বিদেশী শ্রমিক কাজ করতে পারবে তা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় দেশটিতে জীবনধারণ ব্যয় প্রচুর বেড়ে গেছে। ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ইকবালের মতো স্বল্প মজুরি পাওয়া বিদেশী শ্রমিকরা।
এ পরিস্থিতিতে দেশটির শ্রমবাজার থেকে বিদেশী শ্রমিকদের একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে; যা সৌদি আরবের জন্যই ক্ষতিকর হয়ে উঠছে। বিদেশী শ্রমিকদের আকস্মিক বহির্গমনপ্রবাহ সৌদি অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর প্রচেষ্টায় থাকা যুবরাজ প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমানের জন্যও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যুবরাজ সালমানের পরিকল্পনার কেন্দ্রে রয়েছে সৌদির বেসরকারি খাতে স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি। বর্তমানে এ খাতটিতে বিদেশী কর্মীদেরই আধিপত্য। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বিদেশী শ্রমিক চলে গেলে এ খাতে যে পরিমাণ শূন্য পদ সৃষ্টি হবে তা পূরণের জন্য সৌদি নাগরিকরা যথেষ্ট নয়। আর পর্যাপ্ত কর্মী না পেলে অর্থনৈতিক নিম্নমুখিতায় ধুঁকতে থাকা ব্যবসায়ীদের ওপর তা আরো চাপ সৃষ্টি করবে।
সৌদির পরিসংখ্যান দপ্তরের সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের শুরু থেকে গত বছরের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত শ্রমবাজার থেকে ১১ লাখের বেশি বিদেশী কর্মী সৌদি ছেড়েছে। অবশ্য বিদেশী শ্রমিকদের বড় একটি অংশ চলে যাওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। ২০১৩-১৭ সালের মধ্যে হাজার হাজার বিদেশী কর্মী সৌদি ছেড়ে যায়। যদিও তখন প্রস্থানের কারণ ছিল ভিন্ন। কর্ম ভিসা স্পন্সরশিপ প্রোগ্রাম লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে সৌদি সরকারের ধরপাকড় অভিযানে সে সময় অনেক বিদেশী কর্মীই সৌদি ছেড়েছিলেন। কিন্তু বিদেশী শ্রমিকদের সাম্প্রতিক বহির্গমন ঘটছে অর্থনৈতিক কঠোর অবস্থা এবং জীবনধারণের কষ্ট থেকে।
এ মুহূর্তে হতাশাজনক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্টে সংগ্রাম এবং সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পর নিজেদের ভাবমূর্তি উদ্ধারের চেষ্টায় রয়েছে সৌদি। এ অবস্থার মধ্যে শ্রমবাজারে পরিবর্তন দেশটিতে অনিশ্চয়তার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বিষয়টি সৌদি সরকারকেও ভাবিয়ে তুলেছে। ব্লুমবার্গ নিউজের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত বছরের শেষের দিকে বিদেশী কর্মীদের ওপর ফি আরোপের নীতিমালা তুলে নেয়া বা শিথিলের বিষয়টি বিবেচনা করেছিলেন সৌদি কর্মকর্তারা। তবে নীতিমালায় পরিবর্তন-সংক্রান্ত এখন পর্যন্ত কোনো ঘোষণা আসেনি এবং ফি এখনো অব্যাহত রয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদে বিদেশী কর্মীদের প্রস্থান সরকারের সবচেয়ে অগ্রাধিকারমূলক পরিকল্পনার একটি অংশ। অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে সৌদির বিশাল তরুণ প্রজন্মের জন্য কাজের সংস্থান করা। বর্তমানে দেশটির মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশির বয়স ৩০ বছরের নিচে। এ বিপুলসংখ্যক তরুণের কাজের ব্যবস্থা না করে দিতে পারলে অন্য আরব দেশগুলোর মতো এখানেও হতাশা থেকে তরুণরা বড় ধরনের আন্দোলনের ডাক দিতে পারেন, যা সৌদি রাজতন্ত্রের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে।
এ অবস্থায় ১২ দশমিক ৯ শতাংশ বেকারত্ব হার সৌদি সরকারের অন্যতম উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। বর্ধনশীল বেকারত্ব হারের কারণে সরকারকে স্বল্পমেয়াদে বেকারত্ব কমানোর লক্ষ্য পরিবর্তনে বাধ্য করছে। কিন্তু এতে করে সৌদির স্থানীয় কর্মীদের কর্মপ্রত্যাশা ও প্রাপ্য কাজের মধ্যে ব্যবধান আরো প্রকট হয়ে উঠছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিদেশী শ্রমিকরা মূলত নির্মাণ অথবা রিটেইল খাতের স্বল্প মজুরির কাজগুলো করতেন, ফলে তারা চলে যাওয়ার পর এসব কাজই থেকে যাচ্ছে, যা সৌদির স্থানীয়দের মোটেও পছন্দ নয়। ফলে বিদেশী কর্মী নির্ভরশীল খাতগুলো এখন ধুঁকছে।
সৌদির অন্যান্য শহরের মতো জেদ্দার ভবনগুলো খালি পড়ে রয়েছে এবং যেসব দোকানপাট আগে বিদেশী কর্মীর মাধ্যমে পরিচালিত হতো, সেগুলো এখন রীতিমতো টিকে থাকার সংগ্রাম করছে। গত সাত বছর উপকূলীয় শহর জেদ্দায় কাজ করেছেন ফিলিপাইন থেকে আসা ক্রিস্টিয়ান ল্যাক্যাপ। সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় তিনি সৌদি ছেড়ে কানাডা বা দক্ষিণ কোরিয়া চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বলেন, ভালো বেতনভোগী সৌদি নাগরিকরা এ খরচ বহন করতে পারবে। আমাদের মতো স্বল্প মজুরিপ্রাপ্ত শ্রমিকদের জন্য তা খুবই কঠিন।
আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের পার্সিয়ান গালফ অঞ্চলগুলোর রাজনৈতিক অর্থনীতি-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কারেন ইউয়াং বলেন, অনেক সৌদি নারী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন, এটি খুবই ভালো সংবাদ। অন্যদিকে অনেক উচ্চশিক্ষিতই তাদের দক্ষতা অনুযায়ী কাজ পাচ্ছেন না।
যুবরাজ সালমানের আগ্রাসী নীতিমালার কারণে সৌদি আরবের ব্যবসায়িক পরিবেশও এ মুহূর্তে অনুকূলে নেই। গত বছর দেশটিতে শত শত শীর্ষ ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা এবং রাজপরিবারের সদস্যকে সরকারের ‘দুর্নীতিবিরোধী’ অভিযানের নামে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইউয়াং আরো বলেন, এ ধরপাকড়ে একদিকে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা যেমন ভীত হয়ে পড়ছেন, অন্যদিকে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা লাইসেন্স ও ব্যবসার নিবন্ধন এবং নতুন নিয়োগ নীতিমালা (যেখানে স্থানীয়দের নিয়োগের কথা বলা হয়েছে) বাস্তবায়নে নতুন নতুন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন বলে অভিযোগ করছেন।
এসব সমস্যার সমাধানে সৌদি সরকার বিনিয়োগ বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে এটি কোনো টেকসই পন্থা নয়। সরকার সারা জীবন এভাবে ব্যয় করতে পারবে না।
অর্থনীতি নিয়ে শঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে গত সপ্তাহে দ্বিতীয় শীর্ষ বিনিয়োগ-বিষয়ক সম্মেলনের আয়োজন করে সৌদি প্রশাসন। খনি, জ্বালানিসহ অন্যান্য শিল্পে বিপুল বিনিয়োগ আকৃষ্ট করাই ছিল এ আয়োজনের মূল লক্ষ্য। এছাড়া দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করেছে দেশটি, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় ধরনের স্বস্তির বিষয়। এছাড়া বিনোদন ও পর্যটন খাতও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে দেশটি। ওয়াশিংটন পোস্ট অবলম্বনে।
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | ৭ |
৮ | ৯ | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ |
১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০ | ২১ |
২২ | ২৩ | ২৪ | ২৫ | ২৬ | ২৭ | ২৮ |
২৯ | ৩০ |