| ২০ এপ্রিল ২০১৯ | ৬:০৭ অপরাহ্ণ
বর্তমানে মূর্খ পীর-ফকির নামধারীরা এমন ধারণা নিয়ে বসে আছেন যে, পীর-ফকিরি করার জন্য শরিয়তের ইলম থাকার দরকার নেই, বরং ইলম থাকা দরবেশদের পক্ষে ক্ষতিকারক। কারণ তাদের ভাষায় শরিয়ত এক জিনিস এবং তরিকত-তাসাউফ অন্য জিনিস! প্রথম যুগের সুফি-সাধকদের কিতাব, তাদের বাণী, যেমন ‘কুতুল-কুলুব’, ‘আওয়ারিফুল মাআরিফ’, ‘এইহয়াউল-উলুমিদ্দিন’, ‘কিমিয়ায়ে সা’আদাত’, ‘ফুতুহুল-গায়ব’ এবং হজরত আবদুল কাদির জিলানি (রহ.) এর ‘গুনিয়াতুত-তালেবিন’ গ্রন্থগুলোতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, তরিকত ও তাসাউফের পথ-পরিক্রমার জন্য শরিয়তের জ্ঞান থাকা শর্ত।
হজরত জুনাইদ বাগদাদি (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি পবিত্র কোরআন মুখস্থ করেনি, হাদিসের জ্ঞান অর্জন করেনি, তাসাউফের ক্ষেত্রে তাকে অনুসরণ করা যাবে না। কেননা আমাদের তাসাউফ ও মাজহাববিষয়ক সব ধরনের ইলমই কোরআন-সুন্নাহর জ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তার আরেকটি উক্তি হচ্ছে, ‘যে তরিকত-তাসাউফ শরিয়ত-পরিপন্থি, তা ধর্ম-দ্রোহিতার শামিল।’ হজরত সিররি সিকত্বি (রহ.) বলেন, তিনটি বিষয়ের সমন্বিত রূপের নাম হচ্ছে তাসাউফ,
১. মারেফতের নুর বা জ্যোতি যেন তাকওয়া-পরহেজগারির জ্যোতিকে আহত না করে।
২. আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি বা ইলমে বাতিন বিষয়ে এমন কোনো উক্তি করবে না, যা বাহ্যিকভাবে পবিত্র কোরআনবিরোধী হয়ে যায়।
৩. মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত সীমারেখা লঙ্ঘিত হয়, এমন কোনো কেরামত বর্ণনা বা প্রকাশ করতে যাবে না। পূর্ববর্তী ওলি-দরবেশদের পক্ষ থেকে এ ধরনের আরও বক্তব্য বর্ণিত হয়েছে।
প্রথম শর্ত : পীর-মাশায়েখদের সর্বসম্মত অভিমত হচ্ছে, ‘যিনি কোরআন পড়েননি এবং হাদিসের জ্ঞান অর্জন করেননি, তিনি ওয়াজ-নসিহত করতে যাবেন না।’ তবে হ্যাঁ, মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে কোনো ব্যক্তি যদি পরহেজগার আলেমদের সাহচর্যে দীর্ঘ জীবন অতিবাহিত করেন এবং বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ পরিশুদ্ধি অর্জন করে থাকেন এবং হালাল-হারামবিষয়ক বিধিবিধান পরিপক্বরূপে অবহিত হন এবং পবিত্র কোরআন ও রাসুলের সুন্নাহ বিষয়ে ভালো জ্ঞান রাখেন, তাহলে তেমন কোনো ব্যক্তি ব্যতিক্রম হিসেবে আশা করা যায় ওই দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
দ্বিতীয় শর্ত : কামিল পীরের ক্ষেত্রে বায়াত নেওয়ার জন্য দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, তার সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও তাকওয়া-পরহেজগারি থাকতে হবে। সুতরাং মুর্শিদকে অবশ্যই কবিরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হবে এবং সগিরা গোনাহেও বারবার জড়িয়ে পড়বেন না।
মাওলানা শাহ আবদুল আযীয (রহ.) বলছেন, পীরের জন্য তাকওয়ার শর্তের কারণ হচ্ছে, শরিয়তে বায়াত বিষয়টি বিধিবদ্ধ হয়েছে অভ্যন্তরীণ পরিশুদ্ধির লক্ষ্যে। মানবতার এ আত্মিক পরিশুদ্ধি তাদের সমশ্রেণির সবার দ্বারা হয়ে ওঠে না। কারণ বাস্তবতা হচ্ছে যাদের আমল নেই, তাদের কথায় পরিশুদ্ধি আসে না।
যিনি মুর্শিদ হবেন, তিনি যদি অভ্যন্তরীণ আমল-তাকওয়া, তাজকিয়া সম্পন্ন না হন, তাহলে তার দ্বারা বায়াতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে অনিবার্যভাবেই।
তৃতীয় শর্ত : বায়াত গ্রহণকারীর ক্ষেত্রে তৃতীয় শর্ত হচ্ছে, তাকে মনের দিক থেকে দুনিয়াত্যাগী হতে হবে, পরকালমুখী হতে হবে, তাকিদপূর্ণ ইবাদত-আনুগত্যে এবং সহিহ হাদিসগুলোতে বর্ণিত জিকির-দোয়া নিয়মিত পালন করতে হবে এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সঙ্গে তার কলবের সম্পর্ক সার্বক্ষণিক থাকতে হবে, আর এটি তার স্বাভাবিক যোগ্যতা ও স্থায়ী অভ্যাসে পরিণত হতে হবে।
চতুর্থ শর্ত : বায়াত গ্রহণকারী পীরের ক্ষেত্রে চতুর্থ শর্ত হচ্ছে, তাকে কল্যাণ কাজে আদেশ প্রদান এবং অকল্যাণ কাজে নিষেধের দায়িত্ব নিজের বুদ্ধি-বিবেচনায় উত্তম পন্থায় পালন করে যেতে হবে, যেন তার আদেশ-নিষেধে আস্থা-বিশ্বস্ততা প্রমাণিত হয়। এমন যেন না হয় যে, তিনি একগুঁয়েমি করছেন, চাটুকারিতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন, যার কোনো স্বকীয়তা নেই, আত্মমর্যাদাবোধ নেই।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘সাক্ষীদের মধ্যে যাদের ক্ষেত্রে তোমরা সন্তুষ্ট।’ (সূরা বাকারা : ২৮২)। অর্থাৎ যারা আস্থাভাজন তাদের সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ কর। সুতরাং বায়াত গ্রহণকারীরও তেমন আস্থাভাজন ব্যক্তিত্ব হতে হবে।
পীরের প্রতি ভক্তি, আস্থা পোষণ করার মতো তার তাকওয়া, যোগ্যতা, বাহ্যিক আচরণ থাকা চাই। তাহলে মুসলমানরা এগুলোকেই তার অভ্যন্তরীণ অদৃশ্য যোগ্যতার বাস্তব প্রমাণ মনে করে তার কাছে বায়াত হতে পারবে
পঞ্চম শর্ত : বায়াত গ্রহণকারী পীরের পঞ্চম শর্ত হচ্ছে, তাকে পীর-মাশায়েখদের দীর্ঘ সাহচর্য গ্রহণকারী হতে হবে। ওস্তাদ-পীরের সুহবতে থেকে দীর্ঘকাল সাধনার মাধ্যমে নিজেকে আদব-আখলাকে সজ্জিত করে নিয়েছেন, এমন হতে হবে এবং আত্মিক সাধনার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নুর, প্রশান্তি প্রাপ্ত হতে হবে। এটি জরুরি এজন্য যে, মহান আল্লাহর সৃষ্টিগত রীতি ও বাস্তবতা হচ্ছে, সফলতা লাভকারীদের দেখে দেখে অন্যরা সফলতাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। যেমন কোনো ব্যক্তি আলেমদের দীর্ঘ শিষ্যত্ব গ্রহণ না করে ইলম শিক্ষা করতে পারে না। একই নিয়মে অপরাপর জ্ঞান, বিজ্ঞান, কারিগরি ক্ষেত্রেও দীর্ঘ সময় ব্যয় না করে বাস্তব যোগ্যতা-অভিজ্ঞতা অর্জন সম্ভব হয় না।
পীর-মুর্শিদের ক্ষেত্রে বায়াত নেওয়ার জন্য তার কেরামত প্রকাশ পাওয়া, অলৌকিক কিছু প্রদর্শনে সক্ষম হওয়া এবং তার হালাল রুজি উপার্জনের পেশা-চেষ্টা পরিত্যাগ করার শর্ত আরোপ করা যাবে না। কেননা কেরামত বিষয়টি একজন শায়খ বা পীরের কঠোর সাধনা-প্রচেষ্টার ফল হিসেবে মহান আল্লাহ কারও কারও জন্য প্রকাশ করে থাকেন। এটি সংশ্লিষ্ট পীরের যোগ্যতার মাপকাঠি নয় এবং তার নিজের ইচ্ছাধীনও নয়।
দ্বিতীয় বিষয়টি অর্থাৎ প্রয়োজনীয় হালাল আয়-উপার্জনের পেশা ও চেষ্টা পরিহার করা শরিয়ত-বিরুদ্ধ কাজ। সুতরাং মাজজুব-অসহায় লোকদের দেখে উপার্জন/সম্পদ বিষয়ে ধোঁকায় পড়া যাবে না। অবশ্য এক্ষেত্রে শরিয়তের নির্দেশ এটুকুই যে, অল্পে তুষ্ট থাকা এবং সন্দেহজনক আয় ও পেশা থেকে বেঁচে থাকা জরুরি।
শাহ সাহেব (রহ.) এখানে বলছেন, পীর বা শায়খের ক্ষেত্রে এমনটিও শর্ত বলা হয়নি যে, তার চূড়ান্ত পর্যায়ের সন্ন্যাসব্রতী হতে হবে অর্থাৎ নিজেকে কঠিন ইবাদত, সাধনায় জড়িয়ে রাখতে হবে। যেমন একনাগাড়ে সারা বছর রোজা পালন, সারা রাত জেগে ইবাদত করা, স্ত্রী-সংসার পরিত্যাগ করা, সুস্বাদু খাবার পরিহার করা, পাহাড় বা জঙ্গলে চলে যাওয়া, যেমন আমাদের সময়কার সাধারণ জনগণ এসবকে কামালতি মনে করে থাকে। এগুলো ধর্ম বিষয়ে বাড়াবাড়ি এবং নিজ জীবনকে অত্যাচারে নিমজ্জিত করার নামান্তর।
প্রিয়নবী (সা.) এরশাদ করেছেন ‘নিজ জীবনকে কঠোরতায় জড়াতে যাবে না, নতুবা মহান আল্লাহও তোমাদের কঠোরতার মুখোমুখি করে দেবেন।’ প্রিয়নবী (সা.) আরও বলেছেন ‘ইসলাম ধর্মে বৈরাগ্যের স্থান নেই।’
সূত্র : আল কাউলুল জমীল
অনুবাদ : মুফতি মোহাম্মদ আবদুল্লাহ