• শিরোনাম


    একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্ম [] আদিত্ব্য কামাল

    | ২৫ মার্চ ২০২২ | ৯:০৩ অপরাহ্ণ

    একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্ম [] আদিত্ব্য কামাল

    ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ- এতটা রক্তমাখা সূর্যোদয় হয়ত এদেশের মানুষ কখনো দেখেনি, কিন্তু এ এক নতুন সূর্য, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সূর্য। আর আজ তার সুবর্ণজয়ন্তী।
    মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীন। তার এই জন্মগত অধিকার যখন অন্যের দ্বারা লুণ্ঠিত হয় তখনই সে প্রতিবাদ করে ওঠে। সর্বস্বের বিনিময়ে নিজের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়। দীর্ঘদিনের বহু প্রজন্মের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে নিজেদের স্বাধীন জাতি হিসেবে ঘোষণা করার দিন। ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালির লড়াইয়ের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। স্বাধীনতার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এ জাতি রক্ত দিয়েছে, নিজেদের জীবনকে অকাতরে উৎসর্গ করেছে। সংগ্রামের পথে গৌরবময় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে।
    বাঙালির জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য সবচেয়ে বেশি। কেননা অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে এই দিনটি আমাদের পাওয়া। আজকের এই দিনটি সমগ্র দেশবাসীর বহুকালের লালিত স্বপ্নের ফল। বাঙালি প্রতিজ্ঞা এবং সংগ্রামের অঙ্গীকারে উদ্দীপ্ত হয় এদিনে। ২৬ মার্চ বাঙালির আত্মপরিচয়ের গৌরবে উজ্জ্বল, ত্যাগে ও বেদনায় মহীয়ান একটি দিন। নিপীড়িত, বঞ্চিত ও শােষিত মানবের মুক্তির স্বপ্নসাধ পূরণের মহিমায় অমর এ দিন। জাতীয় ঐক্য এবং দেশপ্রেমের অনুভূতিতে গরীয়ান একটি দিন স্বাধীনতা দিবস। প্রতিবছর এ দিনটি আমরা পালন করি আনন্দে, শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে এবং জাতীয় চেতনায় উদ্বেলিত হয়ে। পাশাপাশি আমরা আত্মসমালােচনার মাধ্যমে নিজের অবয়বটি দেখতে চেষ্টা করি মনের আর্শিতে। আত্মজিজ্ঞাসায় আমরা হই জর্জরিত। আবার নতুন করে প্রতিজ্ঞা করি দেশকে এগিয়ে নিতে।
    স্বাধীনতা মানে শৃঙ্খল ও শােষণের করাল গ্রাস থেকে নিজের মুক্তি, আর আত্মোন্নয়নের পথে স্বাধীনভাবে অগ্রসর হওয়ার সুযােগ লাভ। কিন্তু এ সুযােগ আমরা কতখানি সদ্ব্যবহার করেছি, কতখানি আমাদের শুভ অর্জন, তা মূল্যায়ন করে দেখার জন্য প্রতিবছর আমরা পালন করি স্বাধীনতা দিবস। আমরা খতিয়ে দেখি আমাদের ব্যর্থতার নেতিবাচক দিকগুলাে। আর প্রত্যাশা রাখি সুন্দর আগামীতে। যেনো স্বাধীনতার আরেকটি বছর আসার আগে নিজেরা আরেকটু উন্নত হতে পারি। আরও এক ধাপ এগিয়ে নিতে পারি দেশকে সেই প্রত্যাশা সকলের মাঝেই থাকে। আমরা চেয়েছিলাম শােষণহীন একটি স্বাধীন দেশ, একটি প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা। আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল দুঃখী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন। চেয়েছিলাম শিক্ষা-সংস্কৃতিতে, গণতান্ত্রিক চেতনায় আমাদের স্বাধীন ও স্বনির্ভর একটি দেশ গড়ে তুলতে যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মমতাময়ী মায়ের নেতৃত্বে ধীরে ধীরে শূন্যের কোটা থেকে পূর্ণ হচ্ছে।
    ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর বাঙালি জাতিকে দীর্ঘ ২৪ বছর পাকিস্তানি শোষকদের বর্বরোচিত শোষণের নির্মম শিকার হতে হয়। পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ বাঙালি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে মৃত্যুপণ সংগ্রাম শুরু করে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, তিরিশ লক্ষ প্রাণ আর দুই লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশ বাংলাদেশ। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার পথে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর এই গৌরবময় দিনটিই বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘মহান স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে সমাদৃত।
    বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐতিহাসিক পটভূমি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের স্বপ্নবীজ মূলত বপন করা হয়েছিল সেই ১৯৪৭ সালে, ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগের সময়ই। পরবর্তীতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই ক্রমাগত শোষণ, নিপীড়ন, বৈষম্যমূলক আচরণ, ন্যায্য অধিকার প্রদানে অস্বীকৃতি প্রভৃতি আন্দোলনের যাত্রাকে ত্বরান্বিত করে। আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার এই পরোক্ষ সংগ্রাম ১৯৭১ এ এসে অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। অনিবার্য মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় ‘বাংলা’ ভূখন্ড।
    ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ-বেনিয়াদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত-পাকিস্তান দু’টি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যোজন-যোজন দূরত্ব সত্ত্বেও শুধুমাত্র ধর্মের দোহাই দিয়ে পাকিস্থান ও বাংলাদেশ নিয়ে গঠিত হয় নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান। অদ্ভূত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানের শাসকদের অনাচার-অত্যাচার আর সর্বক্ষেত্রে চরম বৈষম্য-বঞ্চনার স্বীকার হয় বাঙালি জাতি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কেবল অর্থনৈতিক শোষণই নয় বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপরও নিপীড়ন শুরু করে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। তখনই ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে শুরু করে।
    ১৯৫২ সালে উর্দুকে আবারও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দিলে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রজনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামে। বর্বর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মিছিলে গুলি চালালে শহিদ হন রফিক, জব্বার, সালাম, বরকতসহ আরও অনেকে। শহিদদের এই পবিত্র রক্তই যেন বাঙালির হৃদয়ে স্বাধীন লাল-সবুজের পতাকার ছবি এঁকে দেয়।
    ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। মুসলিম লীগের অসহায় ভরাডুবিতে নড়বড়ে হয়ে পড়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতার ভিত। ১৯৫৬ সালে পুনরায় সরকারি ভাষায় বিতর্ক, আইয়ুব খানের অপশাসন, পাঞ্জাবি ও পশতুনদের ঋণ বাঙালিদের ওপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়া প্রভৃতি কারণে বাঙালিদের মনের ক্ষোভ ক্রমশ বাড়তে থাকে।
    ১৯৬৬ সালে বাঙালির স্বাধিকারের দাবিতে ঐতিহাসিক ‘ছয়-দফা’ দাবি উত্থাপিত হয়। গণবিক্ষোভ প্রতিহত করতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সামরিক শাসনের মাধ্যমে স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপর চালাতে থাকে অত্যাচার, নিপীড়ন। ১৯৬৮ সালে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের পুরোধা ব্যক্তিত্ব জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মিথ্যা ও সাজানো ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’য় গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু প্রবল গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানি অপশক্তি ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে ছেড়ে দেয়। এমনকি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
    ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। দফায় দফায় বৈঠক করার পরও ক্ষমতালিপ্সু শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে কালক্ষেপণ করতে থাকে। এমতাবস্থায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিশাল সমাবেশের ডাক দেন। সমাবেশের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি- ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ বলে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। এমন একটি উদাত্ত আহ্বানের জন্যই এতদিন যেন অপেক্ষা করেছিল বাঙালি। সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে এই ডাক। সর্বত্র শুরু হয় তুমুল আন্দোলন।
    ২৫ মার্চের অন্ধকার রাতে বর্বর পাকিস্তানি পশুশক্তি নিরস্ত্র-ঘুমন্ত বাঙালির ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। এশিয়া টাইমসের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘Indians are bastards anyway’. সামরিক বাহিনীর বড় বড় অফিসারদের নিয়ে বৈঠকে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন- ‘তিরিশ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা কর, তখন দেখবে তারা আমাদের হাত চেটে খাবে।’ সে পরিকল্পনা মতোই ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি আর্মি অপারেশন সার্চলাইট আরম্ভ করে যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেয়া। এরই অংশ হিসাবে সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করে হত্যা করা হয়, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী সমাজ নিধন করা হয় এবং সারা বাংলাদেশে নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা করা হয়।
    ২৫ মার্চ রাতেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতার হওয়ার আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যান। তাঁর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য সংগঠকবৃন্দ অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার গঠন করে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন।
    স্বাধীনতা দিবস অর্থাৎ ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘােষণা অকস্মাৎ সৃষ্ট কোনাে আবেগময় ঘােষণা নয়। এর পেছনে রয়েছে বাঙালির আত্মত্যাগ, আত্মবিসর্জন ও আন্দোলন-সংগ্রামের সুদীর্ঘ রক্তাক্ত পথ। এই অমসৃণ পথ পাড়ি দিয়ে এই দিনে বাঙালি জাতি আরেক রক্তাক্ত পথে চলতে শুরু করল। অতঃপর দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধ, সংগ্রাম, মৃত্যু, লাঞ্ছনা ও চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা লাভ করি বিজয়। হাতে পাই সবুজ-লালের মিশ্রণে তৈরি একটি পতাকা, একটি গর্বিত ভূখণ্ড। ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ‘৫৪-এর সাধারণ নির্বাচন, ‘৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ‘৬৬-এর ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান- এরকম অগণিত আন্দোলন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতি যে প্রত্যাশাকে লালন করে অগ্রসর হয়েছিল, তারপর একাত্তরের রক্তাক্ত মার্চের অসহযােগ আন্দোলন পেরিয়ে ছাব্বিশে মার্চে সেই প্রত্যাশা, সেই স্বপ্ন পরিণত হয়েছিল মহান স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষায়। স্বাধীনতার দৃপ্ত ঘােষণার মধ্য দিয়ে সেদিন নিপীড়িত ও বঞ্চিত বাঙালি জনগণের শােষণমুক্তির প্রত্যাশা অর্জন করেছিল এক নতুন দিক-নির্দেশনা, নতুন মাত্রা। সেদিন স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সমস্ত জাতি একাট্টা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র সংগ্রামে। বাঙালি ছিল শােষিত, অত্যাচারিত এবং সকল ক্ষেত্রে উপেক্ষিত। দেশের অর্থসম্পদ, চাকরির সুযােগ-সুবিধা, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই একচেটিয়া করত পাকিস্তানিরা। স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও বাঙালি ব্রিটিশ শাসনামলের মতােই পশ্চিম পাকিস্তানের কৃপার পাত্র হয়ে পড়েছিল। এমনকি, বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে তাদের চিরদিনের মতাে দাস করে দেওয়ার এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পাকিস্তানে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয় উর্দুকে। কিন্তু বীর বাঙালি তা সহ্য করেনি, প্রতিবাদে, সংগ্রামে, আন্দোলনে নস্যাৎ করে দিয়েছিল তাদের সে ষড়যন্ত্র । অবশেষে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালির বিজয়ে শঙ্কিত পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তরে যে টালবাহানা শুরু করেছিল তাতেই বাঙালি বুঝতে সক্ষম হয় যে, এরা বাঙালিকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। তখনই ছিড়ে যায় দুর্বল ঐক্যের রশিটা। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ ও নির্দেশে সমগ্র বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য মানসিক ও বাস্তব প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। ২৬ মার্চ আসে সেই সুযােগ, স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘােষণা এবং বাঙালিদের সশস্ত্র প্রতিরােধ। তাই এদিন আমাদের জাতীয় জীবনের এক মহালগ্ন।
    মূলত ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঘােষিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। এর পরপরই শুরু হয় প্রতিরােধ ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। দেশ স্বাধীন করার প্রত্যয়ে দৃঢ়চিত্ত বাঙালি জাতির ইতিহাসে এ দিনটি একটি মাইলফলক। পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী বাঙালির ওপর প্রায় দুই যুগব্যাপী যে নিপীড়ন ও শােষণের সৃষ্টি করেছিল, তা থেকে মুক্তি পাওয়ার এক অপ্রতিরোধ্য সংগ্রামে বাঙালি একত্র হয়েছিল এই দিনে।
    সর্বস্তরের মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম, বন্ধুরাষ্ট্রসমূহের সর্বাত্মক সহায়তা, বিশ্ব গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা তদুপরি তিরিশ লক্ষ শহিদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অবশেষে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।
    স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জন ও অসাম্প্রদায়িক, কল্যাণমুখী, মানবিক, প্রগতিশীল স্বতন্ত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। মানুষের মৌলিক অধিকার ও ন্যায়সংগত অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে জাতীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠা, শোষণ, বৈষম্য, অন্যায়ের অবসান ঘটিয়ে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত একটি সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
    আমাদের জাতীয় দিবস হিসেবে যতগুলাে দিন রয়েছে, স্বাধীনতা দিবস তার মধ্যে অন্যতম। এ দিনটি শুধু ঐতিহাসিক তাৎপর্যেই অসাধারণ নয়, নবীন জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার শপথে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করার দিন হিসেবেও অনন্যসাধারণ।
    জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য অপরিসীম। এই দিনটি বাঙালির জীবনে বয়ে আনে একই সঙ্গে আনন্দ-বেদনার অম্ল-মধুর অনুভূতি। একদিকে হারানোর কষ্ট অন্যদিকে প্রাপ্তির আনন্দ। তবে শেষ পর্যন্ত সর্বস্ব হারিয়েও স্বাধীনতা প্রাপ্তির অপার আনন্দই বড় হয়ে ওঠে প্রতিটি বাঙালির কাছে। গৌরবোজ্জ্বল এই দিনটি প্রতিবছর আসে আত্মত্যাগ ও আত্মপরিচয়ের বার্তা নিয়ে। স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য। নব উদ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা ও দিকনির্দেশনা নিয়ে আসে এই দিন।
    আমাদের বর্তমান প্রজন্ম স্বাধীনতার ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী। এই প্রজন্মকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে দেশকে এগিয়ে নেয়ার দীক্ষায় দীক্ষিত করতে হবে। এ জন্য এদের হাতে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস তুলে দেয়া জরুরি। জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে সঠিক ইতিহাস সংগ্রহের মাধ্যমে ইতিহাসবিকৃতি রোধের মাধ্যমে তা সম্ভব হতে পারে। দল কিংবা ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে কল্যাণমুখী রাজনীতির চর্চা করতে হবে।
    আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫১ বছর। দীর্ঘ এই ৫১ বছরে ইতিহাসের পাতায় আছে পাওয়া না পাওয়ার শত কথা। অতীতের সকল দুঃখ কথা ভুলে আগামীর দিনে নতুন প্রত্যাশায় এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ধীরে ধীরে উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ও আদর্শকে ধারণ করে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। দেশের প্রত্যেক মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করে যেতে হবে। কেননা এই দেশ বঙ্গবন্ধুর, এ দেশ বাঙালির, এ দেশ আমার আপনার সবার। তাই দেশের উন্নয়নে সকলকেই দেশপ্রেমী হয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করতে হবে।

     আদিত্ব্য কামাল,বার্তা সম্পাদক জনতার খবর
    Facebook Comments Box



    এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

    আর্কাইভ

    শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
     
    ১০১১১২১৩১৪১৫১৬
    ১৭১৮১৯২০২১২২২৩
    ২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
  • ফেসবুকে আওয়ারকণ্ঠ২৪.কম