লেখক: ম. কাজী এনাম, শিক্ষক কাজিপাড়া মাদ্রাসা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। | ২৯ মার্চ ২০১৯ | ৫:৩৬ পূর্বাহ্ণ
পুষ্প খুব ভাল মেয়ে। পড়াশুনোয় শুধু নয়, রূপেগুনে, আচার-আচরন ও সামাজিক যে কোন স্ট্যাটাসে তার উদাহরণ সে নিজেই। মিশুক এমন একটা মেয়েকে এলাকার সকল শ্রেণীর মানুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই ভালবাসে।
আশুগঞ্জের রূপমাধুরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সে এ বছর ভর্তি হয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম তার। মাছবিক্রেতা জনাব আব্দুস সামাদ ফুলের মতো সুন্দর মেয়ে ভেবে নাম দিয়েছিল ‘পুষ্প’
কালক্রমে সে পূষ্পের মতোই প্রস্ফুটিত হয়ে পরিবার, সমাজ ও বিদ্যালয়ে আলো ছড়াচ্ছে। স্বল্প আয়ের আব্দুস সামাদ মিয়া নিজের সর্বাত্মক চেষ্টা-সাধনা ও মনোনিবেশ রাখার চেষ্টা করেন, যেন মেয়ে উচ্চ শিক্ষিত হয়। আর সেজন্য দুইহাত উজার করে খরচ করেন। ভাল কোন মাছ নজরে আসলে আর বিক্রির নাম নেই, মেয়ের জন্য বাড়িতে নিয়ে নেন।
দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় এভাবে পুষ্প আজ অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যায়নরত। জেএসসি পরিক্ষার জন্যে তার দুইটি প্রাইভেট এবং একটি বিদ্যালয়ের কোচিংয়ে যেতে হয়। তদুপরি সে পড়াশোনার পাশাপাশি সামাজিক সকল সকল কর্মকান্ডের মাঝে নিজের অংশগ্রহণ করে। নেচে-গেয়ে মাতিয়ে রাখে সামাজিক সবকটি সাংস্কৃতিক অনুষ্টান। সকলেই তার উদারতা ও মেধার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ঈদানিং সে ফ্যাশনেও বেশ মনযোগী।
তার চলায়-বলায় মুসলিম বুঝা না গেলেও ঈদানিং সে প্রায়শই ফ্যাশনেবল হিজাবে বের হয়। আঁটসাঁট কিংবা খুবই পাতলা সেসব বোরকায় অনেকেরই নজরে সে আর পিচ্ছি পুষ্প নেই। বেশ ভালই বড় হয়ে গেছে। তাছাড়া বোরকায় এমনিতেই মেয়েদের একটু বড় বড়ই মনে হয়।
পুষ্পের বেশ কিছু হিন্দু বান্ধবী আছে। কাজল আর ত্রপা এদের অন্যতম। ত্রপার সাথে তার খুবই সুসম্পর্ক। মাঝেমাঝে ত্রপাদের বাসায় যায়, খাই, আড্ডা দেয়। কিন্ত ত্রপাকে সে কোন দিন আনতে পারেনি। একদিন সে এসেছিল খুব তাড়া দেখিয়ে চলে গেছে। আরেকদিন অনেক জোড়-জবদস্ত করেও কিছু খাওয়াতে পারেনি।
একদিন জুমাবার আব্দুস সামাদ ভাল দেখে পাচ কেজি গরুর গুস্ত আনলেন। পুষ্পের মা মিসেস আঞ্জুমারা বেগম খুবই ভাল পাকশী। যা’ই পাক করেন আব্দুস সামাদের মতে তা’ই নাকি অমৃত হয়ে যায়। পুষ্প ত্রপাকে বিকালবেলা আসতে বলেছিল। সে এসেছে সন্ধায়।
মাছ ব্যবসায়ী ঘরে গরুর গুস্ত খাওয়ার ছোট্ট পারিবারিক অনুষ্টান চলেছে। ত্রপা সন্ধায় এসেছে ঠিক খাবারের মুহুর্তে। সে ইতস্ততভাবে এদিকওদিক থাকাচ্ছে। কেমন যেন অপরাধী অপরাধী একটা ভাব ত্রপার আবয়বে। নিরুপায় হয়ে সে পুষ্পকে একটু তাড়া দিলো, পুষ্প সেই তাড়ায় বায়না ধরল। যেতে হলে গরুর গুস্ত খেতেই হবে, ত্রপা খাইনি। অনেক পীড়াপীড়ির পরেও খাওয়াতে পারেনি। কেউ জানবেনা, অনেক করেও বুঝাতে ব্যার্থ।
এমনই একদিন তাদের মাঝে মনোমালিন্য হয়েছিল হিজাব নিয়ে, ত্রপাকে অনেক চেষ্টা করেও সামান্য সময়ের জন্য হিজাব পড়াতে পারেনি। পুষ্প জানে যে, ত্রপা ধার্মীক না। তবুও সে তার ধর্মের প্রতি অনেক শ্রদ্ধাশীল। ত্রপা ধর্ম নিয়ে কখনো তর্ক-বিতর্ক করেনি, তবে সে এতোটা উদারতা দেখাতে কখনোই আসেনি। অপর দিকে ত্রপাদের পুজোয় ঈদের মত আনন্দ করে, নেচে-গেয়ে একদম একাকার হয়ে যায় মুসলিম ঘরের সুন্দরী পুষ্প। পুষ্প ধার্মীক নয়, অল্পস্বল্প যতদূর জানে ধর্মের অনুষ্টানে অংশ গ্রহণ করে। তবে অন্য ধর্মের প্রতি তার কোন বৈরী ভাব নেই। সে সবার সাথেই মিশতে চাই।
একবার ত্রপাদের দোল উৎসবে পুষ্প গিয়েছিল, হিজাব পড়া না থাকলে বুঝাই যেতোনা যে সে একজন মুসলিম ঘরের মেয়ে। রং-বেরংয়ে রাঙিয়ে দিয়েছিল তার হিন্দু বান্ধবীরা। আব্দুস সামাদ এসব পছন্দ করেন না, আবার একমাত্র আহ্লাদী মেয়েকে কিছু বলতে গিয়েও বলেন না।
নামাজ না পড়লেও প্রতিটি জুম’আর দিন আব্দুস সামাদ সামনের কাতারে বসে ইমাম সাহেবের কথা শুনেন গভীর মনযোগ দিয়ে। ইসলামের জ্ঞান গভিরতা কি মুর্খ আব্দুস সামাদ তেমন বুঝেনা, তবে সে এটাই বুঝে গেছে। ধর্ম যেমন যারযার, ধর্মের কাজও তারতার। কুরবানির উপলক্ষে একদিন আব্দুস সামাদ ইমাম সাহেবকে বলতে শুনেছিল, ‘ইসলাম শ্রেষ্ট ধর্ম, ইসলাম মানবতার ধর্ম, ইসলাম শান্তির ধর্ম!’ এই ইসলামে বলা আছে, যারযার ধর্ম যে যার মতো পালন করুক। তবে আল্লাহ মনোনিত ধর্ম কেবল ইসলাম। ইসলাম উদারতা পছন্দ করে, কিন্তু ধর্মীয় আচার-অনুষ্টান পালনে উদারতার কথা ইসলাম বলেনা। বরং ইসলামে বলা আছে, মুসলিম এবং কুফুরের মাঝে পার্থক্য হলো নামাজ। একজন মুসলিম নামাজ পড়ে, আর একজন কাফের নামাজ পড়েনা। একজন মুসলিম আল্লাহ ছাড়া কাউকে উপাস্য মানেনা, আর একজন মুশরিক আল্লাহর সাথে একাধিক উপাস্যের পুজো করে। এসব কথা আব্দুস সামাদ খুব মনযোগ সহকারে শুনে এবং ভাবে, কিন্ত আমলে নেয়না। ঈদানিং সে মেয়ের কর্মকান্ডের উপর বিরক্ত হয়ে ভাবছে কিছু একটা বলবে..
কোন এক কুরবানির ঈদের দিন প্রত্যুষে মেয়ের সাথে বাক-বিনিময় চলা কালে আব্দুস সামদ বললো,
পুষ্প মা; আমাদের গরুটা কেমন হলো?
পুষ্প বলল, খুব ভাল হয়েছে বাবা।
তাহলে তো ভালই হলো, তোর সকল বান্ধবীদের দাওয়াত দিয়ে রাখিস কিন্তু!
পুষ্প; ত্রপা আর উর্মি ছাড়া সবাইকেই বলে রাখছি।
আব্দুস সামাদ; ঠিক আছে! তবে ত্রপাকে বলিসনি কেন? ঝগড়া-টগরা হয়েছে নাকি?
পুষ্প ; না বাবা, এমনিই!
আ.সামাদ; কারন তো একটা আছেই (?)
পুষ্প ; ঐ যে, সে হিন্দু। একটু সসি টাইপের।
আ. সামাদ; আর তুই?
পুষ্প ; কেন? আমি আবার কি করলাম??
আ. সামদ; আমি এতো সসি-টসি বুঝিনা। আমার কথা হলো একটা ধর্মীয় অনুষ্টানে আরেকজন যাবে কেন? ধর্ম যার, অনুষ্ঠান কেবল তার। ধর্মীয় কাজ সবাই মিলে করা যায়না। আর গেলে এক কাজ কর, তর যে কয়টা হিন্দু বান্ধবী আছে তাদের বল হিজাব পড়ে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতে। এসে গরুর গুস্ত বানিয়ে, রান্না করে খেয়ে যাবে।
পুষ্প; বাবা, ওরা হিন্দু ধর্মের! ওদের ধর্মে হিজাব নেই। গরু ওদের গোমাতা। গরুর গুস্ত ওদের খাওয়া নিষেধ। ওরা খাবে কেন?
আ. সামাদ; তাহলে তুইও তো মুসলিম! তুই এদের পুজোয়, দোল, হোলীখেলা উৎসবে যাস কেন? তোর কি কোন ধর্ম নেই? তোর উদারমনা মনোভাব ভাল, কিন্তু ধর্ম নিয়ে না। মসজিদের হুজুরে বলেছে, ধর্ম পালনে কোন উদারতা নেই। যে যার ধর্ম নিজের বিবেক দ্বারা পালন করবে। তোর বান্ধবীরা তোর চেয়েও ধর্ম পালনে আগ্রহী বেশি। হউক মিথ্যা ধর্ম, তবুও ওদের থেকে তোর ধর্মানুভতি শিক্ষা করা দরকার। তুই কেন নিজের শ্রেষ্টধর্মমুখী মুসলিম হয়েও এখনো এমন উদারতা দেখাতে যাস? তোর কি নিজের ধর্মের প্রতি কোন ভালবাসা নেই?? রাসূলের প্রতি শ্রদ্ধা নেই??
পুষ্প ; আসলেই বাবা, আমদের কিছু উদারতা আমাদের দুনিয়া ও আখেরাত ধ্বংস করার জন্য যতেষ্ট। ধন্যবাদ তোমাকে আমার অন্তচোখ খুলে দেয়ার জন্য।